Skip to main content

"বাঙালী জাতীয়তাবাদ" - আলী রিয়াজ

১।

গত শতকে সত্তর ও আশীর দশকে একটি প্রশ্ন অত্যন্ত প্রবলভাবে আমাদের সমাজ-জীবনকে নাড়া দিয়েছিলো, তা হলো ‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ প্রশ্নটি উত্থিত হয়েছিলো এমনি একটি জটিল, সংক্ষুব্ধ ও উল্ল্যেখযোগ্য সময়ে যে, তা আমাদের ইতিহাসকে একটি আলাদা পথে পরিচালিত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্ন ছাড়াও বাঙালী মুসলমানের জন্যে তা ছিলো আত্মানুসন্ধান ও নব-জাগরণের কাল। বাঙালী মুসলমানরা তাঁদের বিগত ইতিহাসের প্রত্যন্ত প্রদেশে প্রবিষ্ট হয়ে একটি আত্মপরিচয় নির্মানের জন্যেই এই জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বধর্মচেতনা থেকে এই প্রশ্নের উদ্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পশ্চাদমুখী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সংকট এতো সুতীব্র হয়ে উঠেছিলো যে ঐ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর ছিলো না। স্বেচ্ছায় বা পরিবেশের প্রভাবে প্রতিটি জাতিকেই জাতী জাগরণের কোনো না কোনো পর্যায়ে, ঐতিহাসিক ধারার কোনো কোনো স্তরে আত্মপরিচয়ের এই মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। জাতীয় জাগরণের প্রভূত প্রয়োজনের মুখে বাঙালী মুসলমানরাও সেই অবস্থাটিই প্রত্যক্ষ করেছেন গত শতকের সত্তর ও আশীর দশকে। বাঙালী মুসলমানদের ইতিহাস ও নিয়তি যেমন অন্যভাবে রচিত হয়েছিলো এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসও আপন গতিপথ তৈরী করে নিয়েছিলো এই প্রশ্ন উত্থাপনের সাথে সাথে। অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান, বিশেষত সচেতন অংশ এই প্রশ্নের একটি আপাত উত্তর তৈরি করলেও বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রশ্ন বোধকরি সে সময়ই মিমাংসীত হয়ে যায়নি, নিঃসংশয়ও নয়। বরং বাঙালি জাতির আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস তাতে আরো পুষ্ট হয়েছিলো, বেগবান হয়েছিলো, হয়েছিলো শক্তিশালী। আর সেই শক্তির জোরেই ইতিহাসের অন্য এক পর্যায়ে বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রশ্নটি মিমাংসার দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দময় প্রশ্নটি কালক্রমে রক্তাক্ত সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে; সমস্ত বাধা বন্ধনকে অস্বীকার করে বাঙালী একটি জাতি হিশেবে নিজের পরিচয়কে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে পেরেছে। 


বাঙালি জাতির এই আত্মানুসন্ধান-স্পৃহা জাগ্রত হয়েছিলো উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, প্রথম দুটি দশকেই। সমস্ত জড়তা ও কুসংস্কারকে অস্বীকার করে বাঙালি জাতির যে “প্রাণ, মন ও আত্মার সুপ্তিভঙ্গ” (মোহিতলাল মজুমদার, বাংলার নবযুগ, পৃঃ ৯) ঘটেছিলো তাই তার ভেতরে একটি নতুন জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে দিয়েছিলো। এই জাতীয়তাবোধের উৎস স্বধর্মচেতনা ছিল না বটে কিন্তু কালক্রমে তা ঐ সীমাবদ্ধ গন্ডিতে আবদ্ধ হয়েছিলো। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের ভেতরে এই সচেতনতাবোধ জাগ্রত হয়েছিলো পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় ধরে। তবু এটি অনস্বীকার্য যে, বাঙালি জাতি তাদের বিকাশের দুটি পর্যায়েই অস্তিত্বের এই তীব্র ও তীক্ষ্ম প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তাতেও আমাদের জাতীয়তার প্রশ্নকে মিমাংসীত বিষয়ে পরিণত করতে পারা যায় নি। আর সেই কারণেই এই শতকের পঞ্চাশের দশকে আবার প্রশ্ন উঠেছিলো ‘আমরা বাঙালি না পাকিস্তানী?’ কেউ কেউ সেই প্রশ্নকেই অন্যভাবে উপস্থাপন করেছে ‘আমরা বাঙালি না মুসলমান?’ বাঙালীত্ব ও মুসলমানত্বের যে ‘বিরোধ’ বা ‘সম্পর্কের’ কথা একশো বছর আগেই মিমাংসীত হয়ে গিয়েছিলো এইভাবেঃ “পুরুষানুক্রমে যুগ যুগান্তর ধরে বাঙ্গালা দেশের গন্ডীর মধ্যে বাস করে, আর এই বাঙ্গালা ভাষাতেই সর্বক্ষণ মনের ভাব ব্যক্ত করেও যদি বাঙ্গালী না হইয়া আমরা অপর কোন জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের তো আর কখনও উত্থান নাই-ই, অধিকন্তু চির তমসাচ্ছন্ন গহ্বর মধ্যে পতনই অবশ্যাম্ভাবী (নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী, আমামদের কাজ, সওগাত, ৭ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩৬, উধৃতঃ সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমতঃ মুসতফা নুরউল ইসলাম, পৃঃ ১৬২)। সেই একই প্রশ্ন একশো বছর পরেও পুনুরুত্থিত হয়েছিলো কেননা অপর একটি সহগামী প্রশ্ন ‘আমরা বাঙালি না পাকিস্তানী’?’ - এর উপরে গুরুত্ব আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। জাতি হিসেবে পাকিস্তানির ধারণা সম্প্রসারিত করতে পারেননি, প্রমাণ করতে পারেননি তার যৌক্তিকতা। সেই দুর্বলতাটি ঢাকতেই তাঁদেরকে বেছে নিতে হয়েছিলো এই পুরনো প্রশ্নটি। গত শতকের এই প্রশ্নটিতে ছিল উদার মনের পরিচয়, এই শতকে তার রূপ সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ। ‘বাঙালি না পাকিস্তানি?’ এই প্রশ্নও এখন একই রকম সংকীর্ণতাদোষে দুষ্ট। জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার যে কলুষমুক্ত রাখবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো, তা পালিত হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক যদিও, সমস্ত ধর্মীয় ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে একটি ‘পাকিস্তানি জাতি’ গঠনের কথা বলেছিলেন (দ্রষ্টব্যঃ ১৯৪৭ সালের ১১ অগাস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের বক্তৃতা) তথাপি তা পরবর্তী পর্যায়ে আর অনুসৃত হয়নি। উপরন্তু তাতে এসেছে নীচ সাম্প্রদায়িকতা, এসেছে স্বার্থ উদ্ধারের হীন প্রচেষ্টা। বাঙালী জাতির পক্ষে সে কারণেই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কষ্টকর ছিলোনা; ছিলো অত্যন্ত সহজ সরল। এবং সেই পথ ধরেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হয়েছে। 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অতি সাম্প্রতিক কালে আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে ‘আমরা বাঙালি না বাংলাদেশী?’ পূর্ববর্তী কালে ঠিক যে আঙ্গিকে এই ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম তা থেকে এই প্রশ্ন কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের জাতিসত্ত্বাকে ঘিরে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তা আমাদের অগ্রগতির বা পশ্চাদগামীতার পথের মাইলস্টোন হিসেবেই কাজ করেছে ও করবে। পূর্ববর্তীকালে কখনো কখনো আমাদের জাতিসত্ত্বাকে ঘিরে এইসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে আমাদের নিরংকুশ অগ্রযাত্রার পথকে রুদ্ধ করবার জন্যে। কখনো কখনো এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যেন আমরা একটি মিমাংসীত বিষয় নিয়ে ব্যাপৃত থাকি। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরী করে আমাদের চিন্তা চেতনার স্রোতকে রুদ্ধ করতে চাওয়া হয়েছে, চেষ্টা হয়েছে আমাদের কর্মোদ্যগকে সীমাবদ্ধ গন্ডীতে আবদ্ধ রাখতে। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’- এর যে কল্পিত ধারণা আজকে সরবে প্রচারিত হচ্ছে তার মূল লক্ষ্যও তাই। তদুপরি আরো একটি গভীর ষড়যন্ত্র বোধকরি এর পিছনে কাজ করছে, তা হলো সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের লড়াই থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আজকে সারা বিশ্বের প্রধান প্রবণতাটির দিকে যেন আমাদের ঝোঁক না আসে, যেন আমরা আমাদের জাতিগত সমস্যার ক্ষুদ্র বিষয়ে নিজেদের নিবদ্ধ রাখতে বাধ্য হই তার জন্যেই এই সংশয় ও সন্দেহ তৈরী করা হচ্ছে। ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের এই সত্যগুলি মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে একদিকে যে আত্মানুসন্ধান -স্পৃহা জেগে উঠেছে এবং অন্যদিকে জাতীয়তার ধারণায় যে ‘দোদুল্যমানতা’ সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়েছে তার কারণ নির্ণয় করতে হলে আরো সূক্ষ্মভাবে আমাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক পর্যন্ত দীর্ঘ দেড়শো বছর আমাদেরকে একটি প্রশ্ন নিয়েই শংকিত, চিন্তিত ও সংশয়াকুল থাকতে হয়েছে/ হচ্ছে- এর কতটা লভাজনক আর কতটা ক্ষতিকর তার বিচার বিশ্লেষণ করতে না পারলে বোধকরি সুযোগ সুবিধা পেলেই বিভিন্ন শ্রেণী বিভিন্ন সময়ে এই প্রশ্ন তুলে ফায়দা লুটবে। সেই হীন প্রচেষ্টাটি রুখে দাঁড়াবার জন্যেই আজকে এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে কিছু সত্য উচ্চারণ জরুরী হয়ে পড়েছে। 

২। 

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশকে যে আন্দোলনের ফলে বাঙালির প্রাণ, মন ও আত্মার সুপ্তিভঙ্গ ঘটেছিলো তার নেতৃত্ব ছিলো এমন একটি শ্রেণীর হাতে যাদের জন্ম ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে দিয়ে। যাদের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস বলেছেন “কলকাতার ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে অনিচ্ছা সহকারে ও স্বল্প পরিমাণে শিক্ষিত ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্য থেকে নতুন একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা সরকার পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত।” (ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যত ফলাফল, উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, পৃঃ ৮৭) এরাই হচ্ছে বাঙালি মধ্যবিত্ত। এদের চরিত্র বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এরা ছিলেন আপোষমুখী ও দোদুল্যমান, ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন, সর্বোপরি উৎপাদন সম্পর্ক থেকে আলাদা। সুবিধাভোগী, শহরবাসী, স্বার্থবাদী এই শ্রেনীর জন্ম হয়েছিলো রাজানুগত প্রভাবশালী শ্রেণী হিসেবে রাজস্বার্থ রক্ষার তাগিদে। যে ব্রিটিশরা… “স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে ভেঙে দিয়ে স্থানীয় শিল্পগুলোকে উন্মুলীত করে এবং স্থানীয় সমাজে যা কিছু মহৎ ও উন্নত ছিল তাকে সমতল করে দিয়ে (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৬) সমগ্র ভারতীয় সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিলো; যাদের ‘অভিজাত শ্রেণি চেয়েছিলো জয় করতে, ধনপতিরা চেয়েছিলো লুন্ঠন এবং মিল-তন্ত্রীরা ছেয়েছিলো সস্তায় বেচে বাজার দখল” (পূর্বোক্ত,পৃঃ৮৭) করতে তাদেরই অনুগত এই শ্রেণীটি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে নব মানবতাবাদের আলোতে স্নান করে উঠেছিলো। তাই তাঁদের, এই আত্মানুসন্ধান বা Renaissance এর ধারণা- Humanism এর ধারণায়া অনেকাংশেই মোহিত হয়েছিলো। যে কথা মোহিতলাল মজুমদার তাঁর “বাংলার নবযুগ” গ্রন্থে বলেছেন “আমাদের অলস অথবা সুপ্ত চৈতন্যে যে আঘাত লাগিয়াছিলো, তা যেমন রূঢ় তেমনই মোহকর (পৃঃ ৩৩) আর বোধকরি সে কারণেই এই নবজাগরণ প্রচেষ্টা ‘সাহিত্যিক নবজন্ম’- এর চেয়ে বেশী ভেতরগামী হতে পারেনি। এদের হাতেই জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রথমবারের মত এই দেশের ভূমিকে স্পর্শ করে। চিন্তা চেতনার দিক থেকে ইংরেজি শিক্ষা তাদের এতটা মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিলো যে, স্বরূপ অন্বেষার এই প্রচেষ্টার অনেকাংশ অনুকরণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছিলো। আর তাই তাদের এই আত্মানুসন্ধান-স্পৃহা ইউরোপীয় renaissance এরই অনুকরণ করতে চেয়েছে। এই দুর্বলতাটি ছাড়াও যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিলো তাদের হাতে তাদের ভেতরেও কিছু অস্বাভাবিকতা ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। গোড়াতে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যকে সংহত  করবার জন্য এই জাতীয়তাবোধ কাজ করলেও ক্রমবিকাশের সাথে সাথে তা পরিগ্রহ করেছে সাম্প্রদায়িক মুখায়বয়বঃ হিন্দু জাতীয়তাবাদ। শ্রেণী-স্বার্থ উদ্ধারের জন্যেই এই চিন্তা-চেতনাকে পরিচালিত করা হয়ছে সাম্প্রদায়িকতার দৃশ্যপথে। 

একদিকে রাজানুগত হিশেবে উদ্ভব হয়েছিলো এই শ্রেণীটির, অন্যপক্ষে সে গ্রহণ করেছিলো পাশ্চাত্য শিক্ষার সুবিধাদি। সঙ্গত কারণেই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তারা একটি বিরাট সুবিধা লাভ করেছিলো- হয়ে উঠেছিলো বিত্তবান, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও এসেছিল এদের অতি সহজেই। এদের এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলো মুসলমান সমাজ। তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন পশ্চাদবর্তী জীবন যাপন করছে তারা। পাশাপাশি হিন্দু মধ্যবিত্তের এই ঔজ্জ্বল্য তাদের ভেতরেও জাগিয়ে দিয়েছিলো আত্মসচেতনতা। সেটি হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর সত্তর বা আশীর দশকের কথা। স্বধর্মচেতনাকে জাগ্রত করবার জন্যেইপ্রশ্ন উঠেছিল, ‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ এই প্রশ্নের উত্তর সে সময়কার সাময়িকপত্রগুলিতে অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘বাঙালীত্ব ও ‘মুসলমানত্ব’- এর এই বিরোধ আপাত হলেও মিমাংসার চেষ্টা কমবেশি সবাই করেছেন। স্বধর্মচেতনার এই সুর ধরেই মুসলমান সমাজের আত্মানুসন্ধানের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। আর মুসলমান সম্প্রদায় ও প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র রেষারেষী থেকেই উদ্ভব হয়েছিলো বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের। এইভাবেই বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের উদ্ভব, বাঙালী মুসলমানের নবজাগরণ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ একটি অদৃশ্য সূত্রে গ্রন্থিত হয়ে গেছে। 

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উদ্ভবের এই দুটি ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে একটি সাযুজ্য অত্যন্ত সহজেই লক্ষ্য করা যাবে তা হলো এই দুই মধ্যবিত্তেরই যাত্রা শুরু হয়েছে বৃটিশ রাজশক্তির সাথে আপোষের মাধ্যমে, আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে যে শ্রেণীর হাতে এই চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটে তাদের অবস্থান যেমন রাজানুগত তেমন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে মুসলিম মধ্যবিত্তের যাত্রারম্ভ অনেক দিনের অসহযোগিতার বন্ধন ছিঁড়ে সহযোগিতার সূত্র ধরেই। অন্য একটি সাযুজ্যের কথাও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে তা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূমিকা। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে সমগ্র নেতৃত্বটিই যেন বর্তেছিলো সাহিত্য সংস্কৃতির কর্মীদের উপরে। বারবার প্রমাণ মেলে নরমান ব্রাউনের এই উক্তিতে- “In Bengal immediate source of nationalism lay in an intellectual renaissance springing partly the introduction of new ideas from the west and partly from revival of indigenous Bengali Literature.” (The United States and India, Pakistan, Bangladesh). দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এই স্বধর্মচেতনার মূল সূত্রটি ধরে রেখেছিলো সাময়িকপত্রগুলো, যার জন্মও প্রায় সমসাময়িক কালেই। 

জাতীয়তাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই দু'টি সময়ের জাগরণকেই সব বলে মনে করলে ভুল হবে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধারাকে এই সময়ের কর্মকাণ্ড সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী করেছে নি:সন্দেহে কিন্তু সত্যি ক'রে বললে তার উৎস এখানে নয়। ইতিহাসের আরো কয়েক ধাপ পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাবো জাতিসত্তার প্রশ্নে একটি অনমনীয় ও ঋজু ভূমিকায় দণ্ডায়মান বাংলাদেশের মানুষদেরকে। আর তাই অতীত ইতিহাসের সাথে বর্তমানের সম্পর্কে'র প্রেক্ষাপটটি আমাদেরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। যে কারণে একজন লেখক সহজেই বলতে পারেন "পাল বা সেন আমলে আংশিকভাবে ও পরে মুসলমানদের আমলে ইলিয়াসশাহী বা হুসেনশাহী রাজত্বে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের এক বিরাট অঙ্গন একচ্ছত্রতলে শাসিত হয়ে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বাঙালী জাতীয়তার সৃষ্টিতে এই সমৃদ্ধ অতীত যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।” (বাঙালী জাতীয়তার উন্মেষ ও ক্রমবিকাশ, তাজুল ইসলাম হাশমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, পঞ্চম সংখ্যা, জুন, ১৯৭৭ পৃঃ ৪৯) বাঙালী জাতিসত্তার অতীত ইতিহাসের শুরু এখানেও নয়; আরো একটু পেছনে। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে হুনদের ভারত আক্রমণের কালে বঙ্গ ও গৌড়ের স্বাতন্ত্র ঘোষণা থেকে এই যাত্রা শুরু বলা যেতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি এই দীর্ঘ একশো বছরের নৈরাজ্যের (ইতিহাসে যে কালকে অভিহিত করা হয়েছে 'মাৎস্যন্যায়') অবসান ঘটে সারা বাংলাদেশে (বঙ্গ,গৌড় ও সমতট-তখন বাংলাদেশ এই তিনটি জনপদে বিভক্ত ছিলো) একটি সমন্বিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তী চারশো বছর ধ'রে পাল বংশের রাজত্ব বাঙালীর জাতিসত্তার বোধকে তীব্র ও তীক্ষ্ণ ক'রে তোলে, বাংলাদেশের ভৌগলিক সত্তাও নির্মিত হয় এই সময়ই। এই চেষ্টা পূর্বে একবার ঘটেছিলো সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে শশাঙ্কের আমলে; কিন্তু 'গৌড়' নামে এই জনপদের মানুষ একটি সমন্বিত রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলেনি-তাঁদের স্বাতন্ত্রবোধ তাঁদেরকে বাধা দিয়েছে। বরং পাল আমলের শেষ পর্যায়ে মহীপালের লুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তাকে সহযোগিতা করেছে আত্ম গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছেয়। অন্যপক্ষে দশম শতকে রাঢ় অঞ্চলে বঙ্গাল দেশ স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছিলো। পাল রাজত্বের সাথে বাঙালী জাতিসত্তার নিবিড় যোগাযোগের কথা একজন ঐতিহাসিক ব্যক্ত করেছেন এইভাবে "পাল রাজত্বের এই চারশো বছর বাঙালীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় যুগ। এই যুগেই হয়েছে আজকের বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির গোড়া-পত্তন। আর্যপূর্ব ও আর্য সংস্কৃতিকে মিলিয়ে বাঙালীর যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এই যুগেই তার ভিৎ তৈরী হয়ে যায়।” (বাঙালীর ইতিহাস। সংক্ষেপে ডক্টর নীহার রঞ্জন রায়-এর 'বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব"; সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পূঃ ৯১)

কিন্তু বাঙালী জাতি-সত্তার বিকাশ ও রাষ্ট্রচিন্তার গতি একই সাথে সমান্তরালভাবে না এগিয়ে যেন থেমে পড়ে পাল আমলের শেষে। তাই ব'লে জাতিসত্তার সচেতনতাবোধ কোনোভাবেই লুপ্ত হয়নি, বোধকরি 'মাৎস্যন্যায়' তাঁদেরকে সেই সচেতনতাই শিক্ষা দিয়েছিলো। সেন আমলের শেষ পর্যায়ে দ্বাদশ শতকে ত্রিপুরায় গড়ে ওঠে এই স্বাধীন রাষ্ট্র। মুসলমানদের আগমন এই সময়েরই ঘটনা। দ্বাদশ শতকে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার একটি প্রধান অংশ দখল ক'রে নেন। স্বাধীন জাতির বিজয় পতাকা উড়তে থাকে পূর্ববঙ্গে। অন্যপক্ষে বাংলার সমস্ত জনপদকে একত্রিভূত করবার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিলো শশাঙ্কের আমলে তা বাস্তবায়িত হয় পরবর্তী পর্যায়ে পাঠান 'আমলে। 'বঙ্গ' নামে এই জনপদের মানুষেরা সর্ব' ভারতীয় ঐক্যের বিপরীতে আপন স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র বজায় রেখে একত্রিভূত হয়। আকবরের আমলে তার আরো বিস্তৃতি ঘটে; বাংলাদেশ 'সুবহ বাংলা' নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

বাঙালী জাতিসত্তা গঠনে এই সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাসই পরবর্তীকালে বাঙালীর আত্মানুসন্ধান-স্পৃহার মৌল-বীজ হিশেবে কাজ করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দুটি পর্যায়ে বাংলাদেশের দুটো সম্প্রদায়ের ভেতরে আত্মানুস্কান ও জাগরন স্পৃহার এই দুই প্রবাহ আমাদেরকে আরো একটি বিষয়ে সচেতন ক'রে তোলে যে, বাঙালী জাতি-সত্তা গঠনের ক্ষেত্রে বাংলা-দেশের বিভিন্ন জনপদের মানুষ ইতিহাসের এক পর্যায়ে সমন্বিত থাকলেও অন্য পর্যায়ে তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়েছে। আর সে কারণেই সাতচল্লিশোত্তরকালে পূর্ব বাংলায় বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিস্তৃতি লাভকরলেও পশ্চিম বাংলায় সেই চেতনা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভেতরে assimilate হয়ে গেছে।


উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী জাতি-সত্তার লুপ্ত ঐশ্বর্য্য অনুসন্ধান প্রচেষ্টা ভারতের তৎকালীন রাজনীতিক কর্মকান্ডের সাথে একত্রীভূত হয়ে যায় কিছু দিনের ভেতরেই। আর তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশের অর্থনীতিক বৈষম্যকে কেন্দ্র ক'রে 'বাঙালী ঐক্য'-এ একটি চিড় ধরতে বাধ্য হয়। ভারতে বৃটিশ শাসনের শুরু থেকেই বাণিজ্যের প্রয়োজনে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। তাতে ক'রে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলকে ঘিরে উন্নয়নের একটি বিপুল জোয়ার চলে আসে। পূর্ব বাংলা ও আসাম তার অতীত সমৃদ্ধি নিয়েও কাঁচামালের যোগানদার ছাড়া আর কিছুই রইলো না। এই যোগানকে ত্বরান্বিত, সহজ ও নিরাপদ করবার জন্যেই পূর্ববাংলায় উন্নয়ণের সামান্য প্রয়াস লক্ষ্য করি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে। সেই মানসিকতাই ১৯০৫ সনের 'বঙ্গভঙ্গ'-এর পেছনে কাজ করেছে। আর তাই একথা অত্যন্ত নির্দ্বিধায় বলা যায়ঃ "বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের প্রশ্নে রাজনীতির তুলনায় বাণিজ্যিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছিল। আর বঙ্গভঙ্গ যখন রদ হল সেখানে বাণিজ্যিক স্বার্থ উদ্ধারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনা বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে।" (ভাষা আন্দোলনঃ পূর্বকাল উত্তর কথা; বদিউজ্জামান; একুশের সংকলন '৭৭ বাংলা একাডেমী পূঃ ১৫) বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র ক'রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার রোপিত বীজ বৃক্ষে পরিণত হলো এবং সেই পথ ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতির নেতৃত্ব বাঙালীর হাত গলিয়ে উঠলো উত্তর-ভারতীয় নেতৃবৃন্দের হাতে। বাঙালী নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বাঙালী জাতির অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দেশের রাজনীতি বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষেই একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ালো। হাজার হাজার বছর ধ'রে বাঙালী আপন স্বাতন্ত্র রক্ষার যে লড়াইয়ে শরীক হয়েছিলো সেই লড়াইয়ের সমস্ত ইতিহাসকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাতচল্লিশে দেশ বিভাগকে মেনে নিলো; সাম্প্রদায়িকতার ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ ও অসহনীয় অবাস্তবতাকে বাঙালী মেনে নিলো অবলীলায়। কেননা আদর্শ'-নেতৃত্ব ও ইতিহাসের চেয়ে শ্রেণী-স্বার্থের ক্ষুদ্রতা ও নীচতাই তাঁদের কাছে হয়ে উঠলো বড়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দোদুল্যমানতা, আপোষমুখীতা ও স্বার্থ'বাদিতার এর চেয়ে আর কোনো বড় প্রমান হতে পারেনা।


পাকিস্তানী শাসকরা প্রথম পর্যায়ে ‘পাকিস্তানী জাতি গঠনে প্রয়াস চালালেও (দ্রষ্টব্যঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র ১৯৪৭ এর ১১ আগস্ট গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণ) ক্রমান্বয়ে তার বাস্তবতায় তারা সন্দিহান হয়ে ওঠেন এবং শেষাবধি তাদেরকে পুনর্বার সাম্প্রদায়িকতাকেই আশ্রয় করতে হয়। ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ মত কল্পিত ও অবাস্তব প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে ধর্মকে আশ্রয় করে একটি সুসংহত জাতি গঠনের দিকে তাঁদের প্রয়াস বইস্তৃত হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জনগোষ্ঠী যারা জীবনাচরণে, ইতিহাস-চেতনায়, দৈহিক গঠনে ও ভৌগোলিক শোভাভূমির দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাঁদেরকে একত্রীভূত করা এবং সর্বোপরি “আত্তীকরণ প্রক্রিয়া-র [আত্তীকরণ (Assimilation) অর্থাৎ জাতীয় বৈশিষ্ট্য লোপ, অন্য জাতির মধ্য বিলীন হয়ে যাওয়া।” লেনিন, জাতি সমস্যার সমালোচনামূলক মন্তব্য।] মাধ্যমে একটি সুসংহত জাতিকে গ্রাস করা সম্ভব হয়নি। বরং পূর্ব বাংলার মানুষ নতুন ‘পাকিস্তানি জাতি’ গঠনের প্রশ্নে এক ধরণের অবশ্যাম্ভাবী আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছে। তা হল রীড মার্গারেট এর ভাষায়- “New nation asking the question as to who and what they were, made was of the concept of folk soul or folk spirit, the thread of continuity by which the present was linked to an ancient past” এই “who and what they were” - এর প্রশ্নের উত্তর তাঁদেরকে বাঙালী জাতি-সত্ত্বার মৌলে পৌঁছে দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বাঙালী এই কথা প্রমাণ করেছে। 


সাম্প্রদায়িকতার অহিফেন কাটিয়ে উঠে বাঙালী ১৯৫২-এর রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে যে আত্ম-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছিলো তা রোধ করবার জন্যেই পুনরায় প্রশ্ন উঠেছিলো “আমরা বাঙালী না মুসলমান” কিংবা “আমরা বাঙালী না পাকিস্তানী?” এই প্রশ্নেরও মিমাংসা সহজে সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল আবধি দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে দিয়ে এই প্রশ্নের শেষ সমাধানও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামলে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের তুঙ্গ বিকাশের কারণে দুই ধরণের বিভ্রান্তি আমাদের ভেতর স্থান পেয়েছে। প্রথমত, বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকারের জন্যেই শুধু জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, একটি রাষ্ট্র-কাঠামো গঠনের ভেতরেই তার উপযোগিতা নিঃশেষিত হয়ে যায়। প্রথমোক্ত ধারণা একাংশে সত্য যে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর কিন্তু তাই বলে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনই জাতীয়তাবাদের শেষ লক্ষ্য নয়।  


জন ভ্যান সাউথওয়ার্থের ভাষায়ঃ The development of nationalism does not only mean to physically protect the nation from foreign invasion but more deeply means to strengthen and flourish its own culture, language, arts, crafts, drama, music which manifests the traditional spirit and identity of the nation (The Story of the World)। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই একপেশে ধারণা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের ভেতরে সঞ্চারিত করা হয়েছে সরকারী পর্যায়ে। বাহাত্তর থেকে পচাত্তর অবধি সাড়ে তিন বছর যে সরকার অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা পরিকল্পিত উপায়েই এই ধারণার সীমাবদ্ধতা আনায়ন করেছেন। কেননা তারা বাঙালি জাতিকে তার ঐ traditional spirit থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, ঐ শক্তির ভয়ে ভীতও ছিলেন। আমাদের জাতীয়তার ধারণায় যে অনিশ্চয়তা আজকে এসেছে তার পেছনে ঐ সরকারী প্রচেষ্টার অবদানো কম নয়। পচাত্তরে রাষ্ট্রীয় উপরিতলে পরিবর্তনের পর অন্য আরেকটি ধারণা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, চেষ্টা হচ্ছে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরী করে মিমাংসীত বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখতে যে, রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের ভেতরেই জাতীয়তাবাদের উপযোগীতা নিঃশেষিত হয়ে যায়। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এর ধারণা ঐ চিন্তা থেকেই উৎসারিত। আর তাই একজন লেখক যথার্থ অর্থেই বলেছেনঃ “… ‘বাঙালী’ কথা বর্জন করে এ রাষ্ট্রের নাগরিককে ‘বাংলাদেশী’ বলার পেছনে আছে অনেকখানি আত্মবিশ্বাস, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আছে সংশয়, জাতীয়তার ধারণার অনিশ্চয়তা” । (দোদুল্যমান জাতীয়তা, আবদুল হক, সমকাল উনবিংশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৮৪) ‘বাঙালী ও বাংলাদেশী’ এই বিরোধের কারণকে দেখতে হবে জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় আদর্শিক চেতনার বিরোধের মধ্যে, ‘শব্দ নির্ভর সংশয়ের (দ্রষ্টব্য সম্পাদকীয়, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২৮ অক্টোবর, ১৯৭৭) বালখিল্যতায় নয়। আর সে প্রেক্ষাপটেই জাতীয়তাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে সৃষ্ট এই অনিশ্চয়তা এবং দিকচিহ্নতা, পশ্চাদগামিতা এবং বিভ্রান্তি… … আত্মবিশ্বাস ও সংশয়’ (দ্রষ্টব্য আবদুল হক, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ) সম্পর্কে আমাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। আমাদের সমৃদ্ধ জাতীয়তাবাদী চিন্তা, identity of the nation এবং traditional spirit- এর সাথে আরোপিত ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’- এর ধারণার যে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’- এর ধারণাকে প্রতিরোধ করা জরুরী। কেননা ঐ চেষ্টার মধ্যে আছে আমদানীর প্রবণতা, আছে অন্ধ-অনুকরণের প্রচেষ্টা। আর জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই সহনীয় নয়; যেহেতু successful nationalism means the identification of a way of life as peculiarly as one’s own positive creation of the people concerned and not as an importation or blind borrowing from others (George M. Foster. Traditional Societies and Technical Change) 


৩। 

আলোচনার শুরুতে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে সাম্প্রতিক বিতর্কের একটি কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে আমি বলেছি যে, সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের লড়াই থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করবার জন্যেই এই বিতর্কের শুরু করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদ ও সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের দ্বন্দ্ব বলে শনাক্ত করাই যথার্থ। জাতীয় প্রশ্ন, জাতীয়তাবাদ, জাতীয় ঐক্য, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রবৃত্তি বিষয়ে যে প্রবল বিতর্ক সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত বিরাজ করছে, সেই প্রসঙ্গের অবতারণার জন্যেই এই মন্তব্যটির ওপরে জোর দেয়ার দরকার রয়েছে। মার্কসবাদীদের মধ্যে এই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে; ফলে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুতর স্থান দখল করে নিয়েছে। তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভুল ব্যাখ্যার ফলে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণটি অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়নি। বিশেষতঃ একটি ধারণা প্রবলভাবে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মধ্যে চালু আছে যে, জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থন সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু এই মন্তব্যটি যে সব সময়ই সঠিক নয় সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা অনেক সোশ্যাল ডেমোক্রেটের পক্ষেই সম্ভব হয় নি। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে পাকিস্তানী শাসনামলে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থনের প্রশ্নে আমাদের মার্কসবাদী কর্মীদের মধ্যে যে প্রবল অনীহা লক্ষ্য করা গেছে তার কারণও এই। আর তা ছাড়া বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রশ্নটি অহরহই উঠেছে। লেনিন ১৯১৩ সালে গোর্কীকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “As regards nationalism I am fully in agreement with you that we ought to take this up more seriously” (Lenin, Collected Works, Vol 35 pp.84) এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার যে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এবং ১৮৯৯ সালে ব্রুন সম্মেলনে এই প্রশ্নটি নিয়ে প্রবল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ার পরও এই প্রশ্নের বিভ্রান্তিগুলো কাটেনি দেখেই লেনিন ১৯১৩ সালে এই ভাবনায় পীড়িত হয়েছেন। বিশেষতঃ এই প্রশ্নে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের নতুন নতুন জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়ছে সে সময়ে, কেননা এ সম্পর্কে মার্কস বা এঙ্গেলসের কোন তত্ত্ব তাদের সামনে ছিলো না। লেনিন সমসাময়িককালের ঘটনাবলী ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে থেকেই এই প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য দাঁড় করিয়েছেন। মার্কসের একটি মৌল বক্তব্য ছিলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে, সেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তবে পোল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড প্রসঙ্গে আলোচনায় তিনি প্রশ্নটি সামান্য স্পর্শ করে গেছেন। সেক্ষত্রে পোল্যান্ডের জাতীয় জাগরণের প্রতি তিনি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন গণতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলনের কারণে, বিপরীতক্রমে আয়ারল্যান্ডের বৃটেনের অন্তর্ভূক্ত থেকে স্বায়ত্বশাসনকে সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। এবং তিনি বিশ্বাস করতেন আয়ারল্যান্ডে শোষণের অবসান ঘটবে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে তিনি ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির একটি শর্ত হিসেবে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকে বিবেচনা করেছেন। তবে আয়ারল্যান্ড প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনটি মূলসূত্র তিনি তৈরী করছেন যেগুলো পরবর্তীকালে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে মার্কসাবাদী তত্ত্ব গড়ে উঠতে সাহায্য করে, এগুলো লোঈ এর ভাষায়- 


  1. Only the national liberation of the oppressed nation enables national divisions and antagonisms to be overcome, and permits the working class of both nation to unite against their common enemy, the capitalists; 

  2. The oppression of another nation helps to reinforce the ideological hegemony of the bourgeoisie over workers in the oppressing nation: ‘Any nation that oppresses another forges its own chains.’

  3. The emancipation of the oppressed nation weakens the economic, political, military and ideological bases of the dominating classes in the oppressor nation and this contributes to the revolutionary struggle of the working class of the nation. 

(Michael Lowy: Marxists and the National Question. New Left Review: Number 96, March-April 1976, pp. 83)


এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় ১৮৯৩ সালে রোজা লুক্সেমবার্গের নেতৃত্বাধীন SDKP (Social-Democratic Party of the Kingdom of Poland) কর্তৃক সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের ধ্বনি তুলে PPS (Polish Socialist Party) - এর পোল্যান্ডের স্বাধীনতার কর্মসূচির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে।  লুক্সেম্বার্গ ও তাঁর সহগামীরা পোল্যান্ডের স্বাধীনতার পরিবর্তে রুশী ও পোলীশ সর্বহারাদের একই লক্ষ্যে একত্রিভূত সংগ্রামের দাবি তুলেছিলেন। তারা রুশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অধীনে পোল্যান্ডের- ভৌগোলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। এই ধারণাটি তাঁরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে উপস্থানন করেন এবং প্রবল সমালোচনার পরে ২য় আন্তর্জাতিকে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সপক্ষে মত ব্যক্ত করা হয়। পোল্যান্ডের স্বাধীনতার বিপক্ষে মত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর রাজনীতিক সংগ্রাম কোনোভাবেই জাতীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে পুষ্ট হতে পারেনা। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পোল্যান্ড রাশিয়ার সাথে একত্রিভূত হয়ে গেছে বলেই স্বাধীনতার দাবীকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘কাল্পনিক’ বলে। এ ছাড়াও জাতিসমূহের য়াত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে তিনি মনে করেন বিমূর্ত ও Metaphysical অধিকার। তা ছাড়া প্রতিটি জাতির আলাদা হবার অধিকার, তিনি মনে করেন বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকেই সমর্থন যোগাবে। কেননা জাতিসমূহের অভ্যন্তরে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলে সবার জন্যই এক অধিকার থাকতে পারেনা। তার এই ধারণার  একটি বিরাট ভুল হচ্ছে অর্থনৈতিক অবস্থানের বিবেচনা; পোল্যান্ড রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল বলে তার রাজনীতিক অবস্থানের বিবেচনা বাদ রাখা যেতে পারেনা- তিনি এটা বুঝতে চেষ্টা করেন নি। জাতিকে একটি সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ বলে যে বিবেচনার কথা তার রচনায় প্রতিভাত হয় তাও ঠিক নয়; সেক্ষেত্রেও রাজনীতিক বিবেচনাকে অগ্রাহ্য করবার প্রবণতাটিও লক্ষ্য যোগ্য। জাতীয়-মুক্তির লড়াইয়ের যে অপ্রত্যক্ষ বিপ্লবী চরিত্র রয়েছে সেটি তিনি এড়িয়ে গেছেন; ফলে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে সর্বহারা শ্রেণীসহ ব্যাপক জনগণের অংশ গ্রহণের কথা ভুলে গিয়ে এটিকে শুধুমাত্র পাতি-বুর্জোয়াদের দাবী বলেই তিনি মনে করেছেন। 


ট্রটস্কি (১৯১৭ এর পূর্ব পর্যন্ত), পেনিনস্ক, স্ট্রসার প্রমুখদের রচনায়ও এই ধরণের বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। ট্রটস্কি জাতি সমস্যার প্রশ্নে দুটি দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করেছেন, একটি ঐতিহাসিক অর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অপরটি রাজনীতিক। তাঁর ধারণায় জাতি হয় একটি অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ নতুবা একটি সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, সে দিক থেকে বিবেচনা করেই তিনি জাতিরাষ্ট্রের পতন ও অবলুপ্তির কথা বলেছিলেন। অন্যপক্ষে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে তিনি জাতি সমূহের ভেতরে শান্তির একটি শর্ত বলে বিবেচনা করেছেন। এই প্রেক্ষাপটেই তিনি পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতার দাবি সমর্থন করেছেন। পেনিকক ও স্ট্রসার জাতীয় স্বার্থের চেয়ে শ্রেণী-স্বার্ত্থের বিবেচনাই বড় বলে গণ্য করেছেন।  পেনিককের কাছে national phenomena is a bourgeois ideological phenomenon অস্ট্রো-মার্ক্সবাদী কার্ল রেননার ও অত্তো বাউয়ারের চিন্তা-চেতনায় বহুজাতিক রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারটা প্রথম দেখা যায়। তারা একাধারে ক্ষুদ্র জাতি-সমূহের অধিকার এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় রাষ্ট্রের ঐক্য কামনা করেছেন। রেননার জাতি সমস্যার প্রশ্নটি প্রশাসনিক, শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত সমস্যায় পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়েছেন। সে কারণেই রেননার- এর ধারণায় এক ধরণের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়, পরিলক্ষিত হয় শ্রেণী প্রেক্ষিতের অনুপস্থিতি ও খানিকটা অমার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি। অত্তো-বাউয়ারের মতবাদে জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ ধারণাটি প্রথম পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু ‘Bauer almost completely excluded classes and the class struggle from the sphere of national culture. His programme aimed to give the working class access to cultural advantages and to the national cultural community from which they were excluded by capitalism. He therefore seemed to consider ‘cultural values’ to be absolutely neutral and devoid of class content” (Michael Lowy, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, pp. 93) তা সত্ত্বেও বাউয়ের-এর জাতি সংক্রান্ত ধারণা (‘never finished outcome of contact process’ ‘frozen piece of history’) ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারণার অনুগামী। 


জাতি সমস্যায় স্ট্যালিনের অবস্থান নিয়ে প্রবল বিতর্ক রয়েছে। জাতির সংজ্ঞা নির্নয় করতে গিয়ে স্ট্যালিন লিখেছিলেন “A nation is historically evolved stable community of people, formed on the basis of a common laguage, territory, economic life and psychological make up manifested in a common culture” স্ট্যালিনের এই বিশ্লেষণ অনুসরণ করলে দেখা যাবে যে, জাতির উদ্ভব বা বিকাশের সাথে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোন স্থান তিনি চিহ্নিত করেননি। তা ছাড়া একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে বিচ্ছিন্ন জাতিসমূহের সমন্বয়ের কথাও তিনি অস্বীকার করেছেন, তাঁর ধারণায় তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ব্যাপার। কিন্তু লেনিনবাদী ধারণায় স্ট্যালিনের মতটি ঠিক নয়। তা ছাড়া মানসগত তত্ত্ব (psychological theory) এর যে ভিত্তিটি তিনি তৈরী করেছেন তা লেনিন কখনোই সমর্থন করেননি। সর্বোপরি স্ট্যালিন যে বড় ভুলটি করেছেন তা হলো বড়-রুশী জারতান্ত্রিক শোষক জাতীয়তাবাদ এবং শোষিত জাতীয়তাবাদের মধ্যে তিনি পার্থক্যটি শনাক্ত করতে পারেননি। দলে জাতি সমস্যার প্রশ্নে স্ট্যালিনের ধারণায় এসেছে এক ধরণের কঠোর ও অবাস্তব রূপ; এসেছে বিভ্রান্তি। জনগণের ‘ভেতর থেকে জেগে ওঠা’ জাতীয়তাবাদ ও ‘উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া’ জাতীয়তাবাদের যে মৌল পার্থক্যটি রয়ে গেছে তার প্রকৃত চেহারা তাঁর কাছে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে। 


জাতি সমস্যার ক্ষেত্রে লেনিনের ধারণাগুলৈ সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ, বাস্তববাদী ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী। কেননা অন্যান্য মার্কসবাদী লেখকরা যখন জাতি সমস্যার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসগত প্রেক্ষাপটটি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তখন লেনিন এই সমস্যাটিকে দাঁড় করিয়েছেন রাজনীতিক ভিত্তির ওপরে। ফলে তাঁর কাছে রাজনীতিক খন্ডিতকরণ (political succession) এবং এক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নই জাতি সমস্যার সমাধান বলে বিবেচিত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার পার্থক্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝতে বোঝাতে পেরেছেন তিনি। তবে এটা ঠিক যে, জাতীয়তাবাদ ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটিকে তিনি আলাদা করে দেখেছেনঃ যে কারণে লেনিন স্পষ্ট করেই বলেছেন- Marxism can not be reconciled with nationalism, be it even of the “most just,” “purest”, most refined and civilised brand. In place of all forms of nationalism Marxism advances internationalism, the amalgamation of all nations in higher unity, a unity that is growing before our eyes with every mile of railway line that is built with every international trust, and every workers association that is formed (an association that is international in its economic activities as well as its items and aims) ( Lenin, Critical Remarks on National Question, Collected Works. Vol. 20 pp.34)


লেনিন জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এই মত পোষণ করলেও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নকে কোনভাবেই অস্বীকার করেননি বরং অন্যান্য বিভ্রান্ত মার্কসবাদী লেখকদের বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সরবে তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন- The awakening of the masses from feudal lethargy, and their struggle against all national oppression, for the sovereignty of the people, of the nation, and progressive (Lenin, পূর্বোক্ত) এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই লেনিন জাতি সমস্যা সমাধানের জন্যে চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া জাতি সমস্যার ক্ষেত্রে যে প্রধান দুটি ঐতিহাসিক প্রবণতার কথা তিনি উল্ল্যেখ অরেছেন সেখানেও দেখতে পাই The first is the awakening of national life and national movements, the struggle against all national oppression and the creation of national states (Lenin, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ pp.27)


এই পর্বের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেনিন লিখেছেনঃ “The typical features of the first period are: the awakening of national movements and the drawing of the peasants, the most numerous and the most sluggish section of the population, into these movements, in connection with the struggle for political liberty in general, and for the rights of the nation in particular. (Lenin, The Right of the Nations to Self-Determinations, Vol,20. pp. 401)


জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে প্রশ্নটি লেনিন এইভাবেই সমাধান করেছেন। সেখানে কোন অস্পষ্টতা ও কুয়াশাচ্ছন্নতা নেই যে, যে কোনো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের লড়াই হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই। সেই লড়াইয়ের বৈপ্লবিক উপাদানগুলো নিয়েই একজন সোশ্যাল ডেমোক্রেটকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চেষ্টা করতে হবে। জাতীয়তাবাদ ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সম্পর্কটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে তাত্ত্বিক ভিত্তি থেকে নয়, বিরাজমান বাস্তবতা থেকে। আমাদের সমাজ পুঁজিবাদের কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই এই প্রশ্নে আমাদের অবস্থানটি নির্ণয় করতে হবে। লেনিন লিখেছেনঃ “a clear distinction must be drawn between the two periods of capitalism, which differ radically from each other as far as the national movement concerned. On the one hand, there is the period of the collapse of feudalism and absolutism, the period of the formation of the bourgeois-democratic society and state, when the national movements for the first time become mass movements and in one way or another draw all classes of the population into politics through the press, participation in representative institutions etc. On the other hand, there is the period of fully formed capitalist states with a long-established constitutional regime and a highly developed antagonism between the proletariat and the bourgeoisie- a period that may be called the eve of capitalism’s downfall” (Lenin, পূর্বোক্ত) আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতটি এমনভাবে বিবেচনা করতে হবে যে, ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে আমরা কোনোভাবেই বিচ্যুত না হই। আর সর্বোপরি আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষ ও বিকাশের সাথে আমাদের সমাজের অবস্থান ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে প্রশ্নটিকে একত্রিভূত করেই বিবেচনা করা জরুরী। পাকিস্তানি শাসনামলে আমাদের এখানে যে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চিন্তাটি গড়ে উঠেছিলো তার প্রধান পরিপ্রেক্ষিতটিই ছিলো জাতি হিশেবে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেষ্টা। শোষিত বাঙালী জাতির মুক্তির লড়াইয়ের লক্ষ্য ছিল Right to Secession অর্জনের। সে ক্ষেত্রে জাতীয়িতাবাদের জন্যে শুধু পাতি-বুর্জোয়াই নয় একইসাথে ব্যাপক জনগণও একটি ‘জাতীয় আন্দোলন তৈরি করেছে। তদুপরি এই চিন্তাটি ‘উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া’ জাতীয়তাবাদ নয় (যেমন বড়-রুশী জারতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ) বরং তা ‘ভেতর থেকে জেগে ওঠা’ জাতীয়তাবাদ। আমাদের এই চিন্তা একদিকে যেমন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সমর্পিত হয়েছে, অন্যপক্ষে তা তেমনি আমাদের আত্মানুসন্ধানেও ব্যাপৃত হয়েছে। এই দ্বিস্রোত আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে একটি আলাদা রূপ দিয়েছে। আমাদের মার্কসবাদীরা এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে তার যৌক্তিকতা বোধকরি তা কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও যে এই আন্দোলনকে পুষ্ট করা যেতো তা তারা বুঝতে পারেন নি যেহেতু তাদের পক্ষে ঐ আন্দোলনের মৌল চরিত্র অনুধাবন সম্ভব হয়নি। তেমনিভাবে আজকে জাতীয়তার প্রশ্নে সংশয় তৈরি করা হচ্ছে এবং আমরা অনুধাবনে ব্যর্থ হচ্ছি যে, এ সংশয়টি তৈরী করা হচ্ছে যাতে আমরা আমাদের দৃষ্টি আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে ফেরাতে ব্যর্থ হই। যে স্তর অবধি আমাদের দৃষ্টি জাতি সমস্যায় স্থিত থাকা প্রয়োজন ছিলো, প্রয়োজন ছিলো ‘national movement’ তৈরি করার তা আমরা উৎরে এসেছি। এখনকার বিবেচনায় শ্রেণী-স্বার্থই জাতীয় স্বার্থকে অতিক্রম করবে, তৈরী করতে হবে সর্বহারা শ্রেণীর ঐক্য- দেশে এবং বাইরে এবং প্রয়োজন ‘unswervingly fight bourgeois nationalism domestic and foreign’ (Lenin, Critical Remarks on National Question, collected works, Vol 20; pp.25) সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এর বিভ্রান্ত ধারণাকে প্রতিরোধ করা দরকার।  



প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯
প্রকাশকঃ তিতাস প্রকাশনী