Skip to main content

“মাত্র ত্রিশ লক্ষ মারা গেছে…”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক বিশ দিন আগে, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১'এ যুক্তরাজ্যভুক্ত উত্তর-আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা পিস নিউজ এর এক প্রতিবেদনে, কেবলমাত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও শাসনযন্ত্র দ্বারা সৃষ্ট খাদ্যাভাবের ফলেই বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ সম্ভাব্য মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয়া হয়। এই প্রতিবেদনে এমনকি ১৯৭৩-৭৪ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বানী করা হয়। পিস নিউজের মূল প্রতিবেদনটি থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত করেছেন- শোভন রেজা, গবেষণা সহকারী, BRI.

 


দুর্যোগের পূর্বাভাসকারীরা প্রায়শই একটা জটিল ধাঁধায় আটকে যান, বিশেষত দুর্ভিক্ষ পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে। তারা যদি তাদের ভয়ঙ্করতম অনুমানটি প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তাদের দেখা হয় আতঙ্ক-সৃষ্টিকারী হিসেবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়। বাংলা দেশে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের পর, ফ্লিট স্ট্রিট (লন্ডন শহরের মিডিয়াপাড়া) হয়তো ১৯৭৪ সালের কোনো এক সময়ে মন্তব্য করে বসতে পারে যে “...মোটে ত্রিশ লক্ষ মারা গেছে …”; অবশ্য বর্তমান অনুমান হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। তবে, পূর্বাভাসকারীটি যদি কিছুই না বলেন, তাহলে তিনি তার নিজের ও মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন হবেন; জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করবেন যে, তিনি যদি সঠিক সময়ে মানুষের অবিশ্বাস ও পরিহাস সহ্য করার ঝুঁকিটা নিতেন, তাহলে হয়তো ভয়ঙ্কর একটা দুর্যোগ এড়ানো যেত।


বিয়াফ্রা যুদ্ধে নাইজেরিয়ার পরাজয়ের ব্যাপারে হার্মান মিডলকুপের করা অনুমান যদিও পরিসংখ্যানগতভাবে ভুল, তবে তা মৌলিকভাবে সঠিক ছিল। এই সহকারী ত্রাণ সমন্বয়ক বলেন, যদি Uli Airstrip এর দায়িত্ব ত্রাণ সংস্থাগুলোর হাতে না দেয়া হয় তবে “৫০ লক্ষ লোক মারা যবে”। বস্তুত, Uli Airstrip গুলো নাইজেরীয় সেনার অধীনে চলে আসে বিয়াফ্রার পতনের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ৫০ লক্ষ ইগোবো (জাতিগোষ্ঠী) আদতে মারা যায় নি। কিন্তু Peace News এর তৎকালীন হিসাব অনুসারেই যুদ্ধের পরেপরেই মারা যায় ১০ লক্ষ লোক। এইযে বাকি লক্ষ মানুষ বেঁচে গিয়েছেন, তার কারণ তারা খরা আর দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে শহরের দিকে সরে যান।

হার্মান মিডলকুপকে যেমন বিয়াফ্রার এই শরণার্থীদের হিসাবে না নেয়ায় দোষ দেয়া যায় না তেমনি ইয়ান ম্যাকডোনাল্ডের মত প্রথিতযশা মানবতাবাদীদেরকেও দোষ দেয়া যায় না, যিনি সাত মাস আগে অনুমান করেছিলেন বাংলা দেশে ১৫ লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষে মারা যাবেন মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, এবং আরো ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা যাবে গ্রীষ্মকালে, আর বর্ষার শেষে মারা যাবেন আরো অগণিত লোক! (পিস নিউজ, এপ্রিল ২১, ১৯৭১)। ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, War on Want এর চেয়ারম্যান, জুলাইতে অনেকটা স্বস্তি প্রকাশ করেই বলেছিলেন যে, ২৫শে মার্চের পাকিস্তানি আক্রমণের পরে, প্রায় পনের লক্ষ লোক ঘূর্ণিঝড় পীড়িত এলাকা থেকে শরনার্থী হিসেবে হলেও সরে যেতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকেই দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে থাকাকালীন ভারতে চলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু বাকি যারা দেশে থাকতে বাধ্য হয়েছেন তারা অপুষ্টির কবলে পড়েছেন। ঠিক যেমন ১৯৪৩ সালে বাংলায় হওয়া দুর্ভিক্ষটি প্রকৃতার্থে তার একবছর আগে ১৯৪২’এই শুরু হয়ে গিয়েছিলো, তেমনি বর্তমান পরিস্থিতো দুর্যোগের রূপ নেবে এক বছরের মধ্যেই।

সাধারণ মানুষ বলতে পারেন “অন্ততঃপক্ষে আমরা কিছু সময় তো পাচ্ছি”। কিন্তু দুর্ভিক্ষ যেখানে অবশ্যম্ভাবী, ‘সময়’ সেখানে শ্রুতিকোমল প্রলয়হুঙ্কারের নামান্তর বৈ কিছু না। যদি জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা প্রত্যাশার চাইতে অধিক ফলপ্রসূও হয়, এর মূল্য দিতে হবে একটি ন্যায্য স্বাধীনতাকামী জাতিকে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে প্রবেশাধিকার পেতে ইয়াহিয়া খানের শাসনকে স্বীকৃতি দিতে হবে জাতিসংঘকে। ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করতে, হাসপাতাল বানাতে গেলেও জাতিসংঘ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করতে বাধ্য হবে।

অর্থাৎ অনুমান করা যায়, জাতিসংঘ হয়তো এই উপায়ে ১৯৭৩ এর আসন্ন দুর্ভিক্ষ এড়াতে সক্ষম হলেও হতে পারে। তবে এই ‘সক্ষমতা’র মূল্য হবে এমন একটি ভূখন্ডে সেনাশক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করা যেখানে তারা “নিজেদের জনগনের” ব্যাপারেই চূড়ান্তরূপে বৈরিভাবাপন্ন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------

বাংলা দেশে বর্তমানে খাদ্যাবস্থার ব্যাপারে তথ্যের উৎস হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে, জাতিসংঘের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন যেটা সানডে টাইমসে (অক্টোবর ১০, ১৯৭১) আলোচনায় এসেছে, শোয়ার্জাল্ডারের একটা প্রতিবেদন, USAid এর সেপ্টেম্বরে করা প্রতিবেদন, ডঃ চেন এবং রোডের Bengal Famine ১৯৪২-৪৩ এর পূর্বাবস্থার সাথে বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ (পিস নিউজ, অক্টোবর ৮), নোয়াখালীর চর জব্বার ইউনিয়নের খাদ্য চাহিদার শুমারি যেটা করেছিলেন ডেরেক ব্রাউন কয়েকটি বিট্রিশ চ্যারিটির সাথে মিলে (অক্টোবর ১৯৭১) এবং ইয়ান ম্যাকডোনাল্ডের অনুসন্ধানগুলো যিনি দাতব্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক হিসেবে- মে মাস থেকে বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এসব তথ্যসূত্রের সাথে যোগ হবে সাংবাদিকদের প্রতিবেদন, শরণার্থী ও ওমেগা কর্মীদের দাবি- তবে এই প্রতিবেদনগুলো ছোট ছোট এলাকা ভিত্তিক কাজ, এবং এখানে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের সুযোগ নেই।

তবে কোনো পরিদর্শকই আসন্ন দুর্ভিক্ষকে অস্বীকার করছেন না- বরং জাতিসংঘের দুই মাস আগের প্রতিবেদনের উপসংহারে এসেছে “১ কোটি ৭০ লক্ষ পাকিস্তানি এই মূহুর্তে চরম খাদ্যাভাবে আছেন”। ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড খাদ্যের অভাবে মারা যাওয়া শিশুদের অনেকগুলো ঘটনার কথা বলেছেন।


কারণসমূহ

কিন্তু বর্তমানের দুর্যোগের পেছনের কারণগুলো কী কী? ডঃ রোড আর চেন বলছেন পূর্ব পাকিস্তানের শিশুরা সাধারণত অপুষ্টিতে ভোগে, আর ৫ বছরের নিচের শিশু মৃত্যুর হার হচ্ছে ২৬% (Famine and Civil War in East Pakistan, Harvard Medical School, August 1971)। তারা এবং ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড আরো কয়েকটি ব্যাপারে একমত যা এই বছরের অস্বাভাবিক খাদ্যাভাবের কারণ হয়ে থাকতে পারে, আর এর প্রত্যেকটিই ১৯৪২-৪৩ এর সেই দুর্ভিক্ষের সাথে মিলে যায় যার ফলে ৩০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল।

ক) বার্মা এবং অন্যান্য স্থান থেকে খাদ্য আমদানি বন্ধ করা হয়েছে।

খ) আমন ফলনের একটি বড় অংশ (এ অঞ্চলের প্রধান তিন ফলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে ফলে) ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

গ) উপকূল অঞ্চল সহ সারাদেশের অধিকাংশ নৌকা, ডিঙ্গি পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে ফেলেছে, সড়ক ব্যবস্থাও নষ্ট করে ফেলেছে। গেরিলারা ব্রিজ ও রেল যোগাযোগ ধ্বংস করেছে। ফলে আভ্যন্তরীন খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

ঘ) বর্তমান খাদ্য মজুদ করা হয়েছে শহরাঞ্চলে। ঢাকা, চিটাগাং এবং খুলনায় প্রায় ৪০% খাদ্যশস্য মজুদ আছে। যার ফলে-

ঙ) খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে (এমন নয় যে প্রচুর খাদ্য গুদামজাত আছে)। কিছু অঞ্চলে ৩০% থেকে ১০০% পর্যন্ত বেশি দামে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে।

এবং

চ) খাদ্যের অবৈধ মজুদ

ভয়ানক অভাব

যেহেতু কৃষকরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর স্বাভাবিক কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, বীজ, এবং সেচের জন্য জ্বালানী সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে- ফলে পুরো বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াই ভেঙ্গে পড়েছে।

জাতিসংঘ আর USAid এর মতে মূল সমস্যা হচ্ছে গুদাম থেকে খাদ্যদ্রব্য পীড়িত এলাকায় পৌঁছানোকে ঘিরে। জাতিসংঘের পরিদর্শকেরা পুরো অঞ্চলকে ৫৯টা এলাকায় ভাগ করেছেন (প্রতিভাগে প্রায় ১২ লক্ষ লোকের বাস) আর এর মধ্যে ১৪টি এলাকা- যশোর, কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালি ও খুলনায় খাদ্যের ভয়ানক অভাব রয়েছে, শরৎকাল জুড়ে আরো ১৯টি এলাকা “সংকটাপন্ন” হতে পারে, আর ২৬টি এলাকা, যদি ভাগ্য সহায় হয় তবে পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ পেতে পারে।

জাতিসংঘ এবং USAid একমত যে বাজারজাতকরণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াই ভেঙে পড়েছে, এবং একে সংস্কার করা সম্ভব না। যদিও তারা সড়ক এবং জলপথে সরবরাহ শুরু করার ব্যাপারে সচেষ্ট, কিন্তু তারা এখনো জানেন না যে ত্রাণ সামগ্রী কি বাইরে থেকে আমদানি হবে, না কি দেশে অবৈধ মজুদ থেকে উদ্ধার করে দেয়া হবে, না মৌসুমী ফসল তোলার পরে দেয়া হবে- না কি সবগুলো মিলেই হবে।

অবশ্য তারা এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় কারণটিকে বুঝতে ব্যর্থঃ



(ছ) ঋণ ও ভাড়া শোধে খাদ্যশস্য ব্যবহারের আচমকা বৃদ্ধি

স্বাভাবিক সময়ে ব্যক্তিগত খাদ্যশস্য ব্যবহার করে ভাড়া এবং ঋণ শোধ করা হতো, দেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের ১৫% ব্যবহার করা হত এমন লেনদেনে। কিন্তু ১৯৭০ এ গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে, এবং মার্চে (১৯৭১) পাকিস্তানিদের আক্রমণে বিলম্বিত এবং বিনষ্ট ফসলের কারণে মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় পীড়িত এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে কারণ এসব এলাকায় গত চারটা ফলন গড়ের চেয়ে কম, বা একেবারেই শুন্য ছিল।

স্বাধীনকৃত এলাকায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার চেষ্টা করছে শতবর্ষের পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে। আট একরের বেশি জমির মালিকদের (জমিদার) উপর অস্থায়ী সরকার করারোপ করছে, এবং এই করের টাকা তাত্ত্বিকভাবে যাবে চিকিৎসা এবং খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের কাজে। তবে এই কর কি ভূমিমালিকদের (চর জব্বারের ৫% লোক যাদের কাছে ৮ একরের বেশি জমি আছে) কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে, নাকি ভূমি ব্যবহারকারীদের (চর জব্বারের ৫০% জনগণ) কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে তা এখনো পরিষ্কার না।

কিন্তু এসব পদক্ষেপ পাকিস্তানের দখলকৃত এলাকায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না, সেখানে এখনো ইউনিয়ন (১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান প্রণীত “মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার” ক্ষুদ্রতম ইউনিট) ব্যবস্থা চলছে, আর জমিদারী এবং মহাজনী ব্যবস্থা হয়ত পাকিস্তানিদের দ্বারা আরো বেশি সমর্থনই পেয়েছে।

ষষ্ঠ পাতায় আমরা ব্রিটিশ কনসর্টিয়ামের ডেরেক ব্রাউনের শুমারির সারমর্ম প্রকাশ করেছি, এই প্রতিবেদন পড়লে বুঝা যায় যে ঋণ কীভাবে পূর্ববাঙলায় খাদ্যাভাবের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।



করণীয় কী?

ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড যেমন বলেছেন, “গত ৬ মাস ধরে ক্রয় ক্ষমতার কমে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো গুরুতর সমাধান না করে কোনো প্রকার স্বাভাবিক খাদ্য সরবরাহের চিন্তা করাটা অদ্ভুত। যদি এই খাদ্যদ্রব্য ত্রাণ হিসেবেও দেয়া হয়, তারপরও গ্রহীতার দিক থেকে কিছু ক্রয় ক্ষমতা থাকা আবশ্যক, যদি এই সরবরাহ দীর্ঘমেয়াদী হয়।“



কিন্তু ব্যাপারটি এত অদ্ভুতও না। দুর্ভিক্ষের চক্র যা আমরা এখন বাংলা দেশে দেখতে পাচ্ছি- খাদ্যশস্য এবং বীজের অভাবের ফলে ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়া, যার ফলে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, মূল্য বৃদ্ধি, ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস, অবৈধ মজুদ, এই চক্র ভাঙতে পারে একমাত্র অন্য একটি চক্র। ত্রাণ দেয়ার সাথে সাথে জরুরীভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে (ব্রিটিশ কনসর্টিয়ামের ভিক্টর পাওয়েলের প্রস্তাবিত রশিদ ব্যবস্থা [system of voucher] একটি সাময়িক উপায় হতে পারে), আর জমিদার এবং মহাজনেরা তাদের প্রতিবেশীদের উপর যে ক্ষমতা এবং প্রভাব খাটায় সেটা দূর করতে হবে (বাঘের উপর টাগ আছে এমন একটা ব্যবস্থা)।

ঋণগ্রস্থ লোককে খাদ্য এবং রশিদ (voucher) দিয়ে খুব কম লাভই হবে যদি এই সাহায্যের অধিকাংশই পাওনাদার জমিদার এবং মহাজনদের হাতে চলে যায়।

কষ্ট লাঘবকারী সাময়িক ত্রাণের বদলে পুরো রাজনৈতিক এবং সামাজিক পুনর্গঠন হবে, জাতিসংঘ কর্তৃক এমন সমাধান প্রস্তাব করারই সম্ভাবনা প্রায় নেই, প্রয়োগ করা দূরে থাক।



মৌলিক দাবী

এমন সমাধানের ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়।

উপসংহারে আমরা বলবো যে আজ পর্যন্ত করা সকল “দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস”- সাংবাদিকদের করা প্রতিবেদন ছাড়া- শুধু দরিদ্র গ্রামের বাসিন্দাদের উপর মনোনিবেশ করে থাকে, আভ্যন্তরীণ শরণার্থীদের প্রতি নয়। এরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ভূমিহীন দরিদ্র, চাকরিচ্যুত এবং গৃহচ্যুত, এবং বিতাড়িত লোক হয়ে থাকেন। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ান এরা, ভারতের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রায়, এদের অনেকেই শিশু এবং বৃদ্ধ, এদের ভাগ্যে ক্লান্তি এবং অপুষ্টির কারণে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নেই। আমরা শুধু তাদের সংখ্যা অনুমান করতে পারি, আর তাদের সাহায্য করার উপায় ভাবতে পারি, মুক্তি ফৌজই একমাত্র উপায় এই শরণার্থীদের সাথে যোগাযোগ করার, কারণ তাঁরা রাতের আঁধারে শরণার্থীদের পথেই আসা যাওয়া করেন। (পিস নিউজ, অক্টোবর ২৯)

একটা ব্যাপার স্পষ্ট- বাংলা দেশে যত বেশি সেনা মোতায়েন হবে, সাহায্য প্রত্যাশী এবং বিতাড়িতদের সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে।

সুতরাং এই যুক্তিতে, যেকোনো ত্রাণ প্রস্তাবকে রাজনৈতিকিকরণ করতে হবে একটি মাত্র মৌলিক দাবীতে যে - বাংলা দেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।