৭ মার্চ, ১৯৭১ আমাদের ঐতিহাসিক দিন। এদিন শুধু সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান নয়; উদ্যানের জমায়েত লক্ষ লক্ষ লোকই নয়; গোটা দেশ-বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল- জয় বাংলা স্লোগানে। এ দিনটির তাৎপর্য অশেষ। একাত্তরের রণধ্বনি জয় বাংলা। ৭ মার্চের ভাষণের সমাপনী ও উদ্দীপনামূলক স্লোগান জয় বাংলা। এ স্লোগান বাঙালির চেতনার দাবানল। অনাগত প্রজন্মের কাছে ৭ মার্চ ও জয় বাংলা ধ্বনির যুগপৎ গুরুত্ব অম্লান করে রাখতে তাই জাতীয় উদ্যোগ ও অনুশীলন আবশ্যক। এ কাজ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়। রাষ্ট্রের কর্তব্য এটি। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রধ্বনি। বাঙালির সঞ্জীবনী বীজমন্ত্র জয় বাংলা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ হচ্ছে বাঙালি জাতির বীজমন্ত্রকোষ। কেবল একাত্তরে নয়। বঙ্গবন্ধু আরও আগে থেকেই জয় বাংলা স্লোগান দিতে শুরু করেন। আঙুল ফুলে কলাগাছ ধরনের ধনী লোকের মতো শেখ মুজিব হঠাৎ নেতা নন। তার রাজনৈতিক দর্শন স্বপ্নে পাওয়া তাবিজও নয়। অভিজাতদের প্রাসাদ-বৈঠকের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত নয়। তার রাজনীতি দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনার পরিকল্পিত আন্দোলন। দীর্ঘ জাগরণ। নির্ঘুম স্বপ্ন।
মার্চ, একাত্তরের প্রতিটি দিন বাঙালির ইতিহাসের একেকটি আগুন অধ্যায়। ৩ মার্চ একাত্তরে পল্টন ময়দানের জনসমুদ্রে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হয় জয় বাংলা স্লোগান। এ স্লোগান বাঙালির দুর্বার জাগরণী শক্তি। একাত্তরের বাংলাদেশ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতাকামী সর্বস্তরের জনতার প্রাণে জিয়ন কাঠির মতো প্রাণদা প্রেরণা ছিল জয় বাংলা। বস্তুত নিখিল-বাঙালির চেতনার আগুনের প্রতিশব্দ তখন জয় বাংলা। ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছিল ১ মার্চ। তার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৩ মার্চ পল্টনে বিশাল জনসভা হয়। তারও আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু যোগ দেন এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি এ সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল। এ সভার শেষে শিল্পীরা জয় বাংলা বাংলার জয় গানটি পরিবেশন করেছিলেন। (দৈনিক ইত্তেফাক ০১/০৩/১৯৭১, সূত্র : প্রাগুক্ত)। জয় বাংলার জন্মানুসন্ধানে আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, ১৫/০২/১৯৭১, সোমবার। এদিন বাংলা একাডেমির মহান চত্বরে ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল। প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু। তার ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের দাবি আদায়ের জন্য রাজনীতি করি। তবে তার মানে এই নয়, আমরা ক্ষমতা চাই না। আমরা দাবি আদায়ের জন্যই ক্ষমতায় যেতে চাই। ক্ষমতা পেলে আমরা একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করব। আমাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত আছে। তবে দাবি আদায় না হলে আমরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে আসব। ‘জয় বাংলা।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংগ্রাম-১৬/০২/১৯৭১; বাঙালির কণ্ঠ, মোনায়েম সরকার সম্পাদিত, আগমনী প্রকাশনী, ঢাকা প্রথম প্রকাশ ১৭ মার্চ, ১৯৭১)।
জানুয়ারি একাত্তরে ঘটে যায় ইতিহাসের কতিপয় অবিস্মরণীয় ঘটনা। ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের মাঠে এক বিশাল জনসভা ছিল। জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে তিনি মার্শাল’ল প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানান। এ সভার মঞ্চটি ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা আকৃতির। মঞ্চ নৌকার মাস্তুলে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত ‘জয় বাংলা’ পাল ওড়ান বঙ্গবন্ধু। জনগণ বজ্রকণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু নিজেও জনতাকে উদ্দীপ্ত করতে স্লোগান দেন- নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর; আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ; জাগো জাগো বাঙালি জাগো; জয় বাংলা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের। সেই শপথনামার শেষ বাক্যটি ছিল- ‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, জয় বাংলা।’ (দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান; ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১; দ্বিতীয় সূত্র : বাংলাদেশ প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী ও সাক্ষাৎকার- শেখ মুজিবুর রহমান; বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা; প্রথম প্রকাশ; ১৭ মার্চ, ২০১৭)। তারও আগে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘নির্বাচনী আবেদন’ শিরোনামে এক ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। ইশতেহারটি প্রকাশ করা হয়েছিল ১ ডিসেম্বর ১৯৭০ তারিখে। সেই নির্বাচনী আবেদনের বক্তব্য শেষ করা হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ জয় ধ্বনি দিয়ে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর, ১৯৮২)।
তবে কি নির্বাচনী ইশতেহারই জয় বাংলা স্লোগানের প্রথম দলিল? না; তা না। তবে একটা কথা আমাদের স্মৃতিতে অম্লান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বিনাশর্তে মুক্তি পান শেখ মুজিব। ছাত্রজনতা অবিসংবাদিত নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। ছাত্রজনতার স্লোগান ছিল শেখ মুজিব জিন্দাবাদ; এগারো দফা মানতে হবে। আরেক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবের বক্তব্যের সারবস্তু ছিল ‘আমি ছয় দফা মানি, আমি এগার দফা মানি’। নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের এক বছর আগে ডিসেম্বর, ১৯৬৯-এ ঘটল আরেক ঐতিহাসিক ঘটনা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার বক্তব্যে ঘোষণা দেন- ‘আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’। (প্রাগুক্ত)। লক্ষণীয় যে, জাতীয় নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু যে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন তাতেও তিনি বহুবার বাংলাদেশ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এমন ঘোষণা এমন বুকের পাটা ইতিহাসে আর নেই।
শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নাম রাখলেন। এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অমোঘ মন্ত্র ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলা স্লোগানটির জন্মও জাতির পিতার পবিত্র জবান থেকে। জয় বাংলা বীজমন্ত্রটি বঙ্গবন্ধু প্রথম উচ্চারণ করেন রেসকোর্সের এক বিশাল জনসভায়। ৭ মার্চ, ১৯৭০। ছয় দফার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু ৫ ডিসেম্বর ঊনসত্তরেই জানিয়েছেন- দুনিয়ার কোনো শক্তিই বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই তিনি রেসকোর্স মাঠের জনসভায় সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন দাবি করেন। ‘তিনি আরও বলেন, ছয় দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই। ইসলাম বিপন্ন কথাটা যারা বলেন, তাদের রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এ জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। এই প্রথম উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা বিপুল উল্লাসধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে স্বাগত জানায়। (এমএ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ; ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা)।
আর বঙ্গবন্ধু সেই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে রণহুঙ্কার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনেক সুধীজনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘ভাঙার গান’ কাব্যের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ শীর্ষক কবিতার মধ্য দিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটির সূচনা করেন। ‘জয় বাংলা উৎসব ২০১৮, মাদারীপুরের পক্ষ থেকে ‘বাঙালির অহংকার’ শীর্ষক জয় বাংলা উৎসব উদযাপন প্রকাশনাটির পাতায় পাতায় উপর্যুক্ত ধারণা ঐতিহাসিক তথ্যরূপে প্রকাশ পেয়েছে। স্বনামধন্য কবি, লেখকও ‘বাঙালির অহংকার’-এ লিখেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, জেলা প্রশাসকসহ সবার প্রদত্ত বাণী ও লেখাতে একই রকম তথ্যের প্রকাশ ঘটেছে। বিষয়টি অমূলক নয়; তাই বলে তা ঐতিহাসিক সত্যরূপে সন্দেহাতীত তা-ও নয়। কেননা বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় কোথাও এমন তথ্য প্রদান করেননি যে, তিনি জয় বংলা স্লোগান নজরুল থেকে গ্রহণ করেছেন। তার শাহাদাতের দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় পরে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কিংবা ‘কারাগারের রোজ নামচা’ গ্রন্থদ্বয়ে এ রকম তথ্য নেই। জাতির পিতা যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের শব্দগুচ্ছ কবি নজরুল থেকে হুবহু নেননি তা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ শীর্ষক কবিতার সংশ্লিষ্ট চরণগুলো খেয়াল করলেই তা স্পষ্টতর হয়ে যায়। চারটি চরণ তুলে ধরছি :
‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ,
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর,
বাংলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’
লক্ষণীয় যে, কবির বক্তব্যের উদ্দেশ্য পূর্ণচন্দ্র এবং তাকে অভিনন্দন সূচক ‘জয়’ ধ্বনি জ্ঞাপন। বাঙালি পূর্ণচন্দ্র যদি দিল্লি, বোম্বে কিংবা বার্মার বাসিন্দা হতেন তাহলে কবি ছন্দের মাত্রা ঠিক রেখে বলতে পারতেন- ‘জয় দিল্লির’ বা ‘জয় বোম্বের’ বা ‘জয় বার্মার’ ধ্বনিগুচ্ছ। কবিতাটির (মূলত গান হিসেবে রচিত) রচনাকাল ১৯২৪ সাল। তার পাঁচ বছর আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত। বৃটিশের সাম্রাজ্য ক্রমশ : ছোট হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
(১৯৩৯-১৯৪৫) নেতাজীর ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান ছিল। স্বাধীন বাংলার আন্দোলন তখন ছিল না। ‘জয় বাংলা’ প্রতিপাদ্যও ছিল না। তবে জয় মুহাম্মদ, জয় কালি, জয় বাবা ভোলানাথ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ প্রচলিত ছিল। যাহোক, বহরমপুর জেলে থাকাকালীন পূর্ণচন্দ্র দাস ও কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে। সখ্য জন্মে। সেইসূত্রে পূর্ণচন্দ্র কারামুক্ত হওয়ার পর আরেক বন্দি কালিপদ রায় চৌধুরীর অনুরোধে কবি অভিনন্দন পত্ররূপে কবিতাটি রচনা করেন। ‘ফরিদপুরের ফরিদ’ ও ‘মাদারীপুরের মর্দ’ বলে কবি তাকে প্রশংসা করেছেন। ফরিদপুর তৎকালীন বঙ্গ বা বাংলা প্রদেশেরই একটি জেলা। কাজী নজরুল নিজেও ভারতবর্ষের প্রদেশ বাংলা ও বাংলা ভাষার কবি। সেই অহঙ্কার অন্তরে ধারণ করেই তিনি ‘বাংলার পূর্ণচন্দ্র’কে জয়ধ্বনি দিয়ে অভিনন্দন জানান- ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’। জয় শব্দটি পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গে আসক্তিযুক্ত; বাংলা-এর সঙ্গে নয়। মোদ্দাকথা শব্দবন্ধটি ‘জয় বাংলা’ নয়; বাংলার পূর্ণচন্দ্রকে জয় জ্ঞাপক-‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’। জয় বাংলা-এর পর্যবেক্ষণে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। নজরুল রচনাবলী-১ খণ্ডে (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬ ) দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট চরণের শব্দগুচ্ছ জয় বাংলার নয়; ‘জয় বাঙলার’। আর বাঙালির বীজমন্ত্রটি শুরু থেকেই জয় বাংলা।
বিশিষ্ট গবেষক বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান চমৎকার বলেছেন- ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভেতর থেকে নজরুল চয়ন করেছিলেন : বাংলার জয় হোক; বাঙালির জয় হোক- অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা। এসব পঙ্ক্তি না থাকলে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলতে পারতেন না। ‘বাংলার জয় হোক’ আর ‘জয় বাংলা’র মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? অতএব নজরুলের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে ঋণী তার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জন্য। আমাদের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে অর্থ ঠিক থাকলেও শব্দের কিছু ভিন্নতা আছে (বাংলার জয় হোক; আর বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন ‘জয় বাংলা’) কিন্তু কবি তার ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় হুবহু ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।’ (কবি নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও ‘জয় বাংলা’, শামসুজ্জামান খান, বাঙালির অহংকার, প্রাগুক্ত)। আমি মনে করি, শামসুজ্জামান খানও একেবারে শেষ বাক্যে এসে সত্যচ্যুত হয়েছেন। কেননা নজরুলের উদ্ধৃত অবিনাশী পঙ্ক্তিগুচ্ছ না হলে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে ‘জয় বাংলা’ মহামন্ত্রটি পেতেন না সত্য। বাংলার জয় হোক; জয় বাংলা সমার্থক হলেও শব্দবন্ধ ভিন্ন তা-ও সত্য। কিন্তু জনাব খান যে বললেন, ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় হুবহু ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা কিন্তু ঠিক নয়।
দ্বিরুক্তি হলেও সংক্ষেপে বলি- নজরুল ‘জয় বাংলা’ বলেননি; বাঙলার পূর্ণচন্দ্রকে বলেছেন ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র’। যেমন বলেছেন, ‘জয় জয় আদি-অন্তরীণ, জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি; ‘জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন’। শামসুজ্জামান খান কথিত শব্দের ভিন্নতাই বঙ্গবন্ধুর উদ্ভাবন। স্বতন্ত্র সৃষ্টি। আমরা জানি, কবি-লেখকের শব্দযোজন ও পরিবেশনার স্বাতন্ত্র্যই তাকে মৌলিকত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামের মহাকাব্যের মহাকবি। পূর্বসূরিদের বিশেষ করে নজরুলের ঋণ স্বীকার করেও ‘জয় বাংলা’ বঙ্গবন্ধুর মৌলিক সৃষ্টি। মহাবীজমন্ত্র উদ্ভাবন।
সম্প্রতি একটা ভালো কাজ হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও ‘জয় বাংলা’-এর একটা অনন্যমাত্রিক ধারাক্রম লক্ষণীয়। শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। তিনি ‘বাংলাদেশ’ নাম রাখেন ৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৯। আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ঐশী বাণীর মতো উচ্চারিত হয় ৭ মার্চ, ১৯৭০। ‘জয় বাংলা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১-এ বাংলা একাডেমিতে বলেছিলেন- ‘আমাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত আছে।’ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। পরাধীনতার কবল থেকে রাজনৈতিক মুক্তি পেয়েছি। বাংলাদেশ আজ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আমরা দ্রুত অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সাংস্কৃতিক মুক্তি এখনও বহু দূরে। সাংস্কৃতিক মুক্তি দল বিশেষের নয়। পুরো জাতির। এজন্য চাই জাতীয় ঐক্য। মহামন্ত্র। জয় বাংলা আমাদের সেই ধ্র“ব বীজমন্ত্র। এতে নিহিত রয়েছে জাতির চেতনাশক্তি। যার ধারাবাহিক অনুশীলন ও বিকাশে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ-উন্নয়ন মূল ধারায় বেগবান ও স্থিত হবে। তাই ‘জয় বাংলা দিবস’-এর উপযোগিতা অনস্বীকার্য।
আবার বলি ‘জয় বাংলা’ আমাদের সংগ্রাম, সার্বভৌমত্ব ও অপরাজেয় জাতিসত্তার সংহত পরিচয়; প্রাণভোমরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘জাতীয় জয় বাংলা দিবস’ প্রচলনের এখনই ঐতিহাসিক ও উপযুক্ত সময়। বঙ্গবন্ধু পূর্বসূরি মহাজনদের অভিজ্ঞান অনুশীলন করেছেন। তিনি কবি গুরুর গান থেকে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখেছেন। সেই গানকে জাতীয় সংগীত করেছেন। কবি নজরুলের ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম’- মনে রেখেই হয়তো তিনি দেশের নাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ’।
তাহলে আমরা কেন পারব না জাতীয় জয় বাংলা দিবস চালু করতে। ৭ মার্চ তো কোনো দলের নয়; জাতির সম্পদ-অহঙ্কার। উল্লেখ্য, বিস্ময়করভাবে ঐতিহাসিক যে তথ্যটি মিলে যাচ্ছে তা হল বঙ্গবন্ধুর পবিত্র উচ্চারণে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জন্মও ৭ মার্চ। তাই ৭ মার্চ ‘জাতীয় জয় বাংলা দিবস’ হলে ৩০ লাখ শহীদ ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। ইতিহাসের দাবি পূরণ হবে। জয় বাংলা।
Date published: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
Author: আসাদুল্লাহ্
Entry Type: অপিনিয়ন পিস
Source: https://www.jugantor.com/todays-paper/jugantar-20-years/273740/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%9C%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97?fbclid=IwAR0JAFkN4caw9GeQ82ldhO0zw9ax3h-eNfzZsaNiOT5Dy7yUde6AQ5F0mH8