বিশেষ সাক্ষাৎকার: রণবীর সমাদ্দার
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ১৭তম বিধানসভা নির্বাচন। সে নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ধর্মসম্প্রদায়ের একটি বিভাজনরেখা এঁকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। সংস্কৃতি ও বামচর্চার পীঠস্থান সেই সমাজ এত দ্রুত পাল্টে গেল কী করে? পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও আসন্ন নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন কলকাতার সমাজবিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্র মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের প্রধান রণবীর সমাদ্দার। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কলকাতার সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী।আমরা শুনে আসছি, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মধ্যবিত্ত বেশ উদার, সংস্কৃতিমনস্ক ও সহনশীল। সে চিত্র এখন রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে। এটাই কি তবে পশ্চিম বাংলা—অন্য রাজ্যের মতোই কট্টর সাম্প্রদায়িক?
রণবীর সমাদ্দার: অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছেন। খাদ্যসাথি থেকে স্বাস্থ্যসাথি—সন্দেহ নেই যে এ ধরনের অসংখ্য প্রকল্প থেকে সাধারণ মানুষের লাভ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো বৈষম্য করা হয়নি। ফলে মানুষ রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ বেড়েছে। এই যে দেওয়ার রাজনীতি, এটা পপুলিজমের রাজনীতি। এটাই মমতার রাজনীতির বড় দিক। এর মধ্যে সবাইকে নিয়ে চলার একধরনের রাজনীতিও আছে।
এখানে তো সবকিছু করা যায় রে বাবা। আমার জীবন আমি যেভাবে যাপন করতে পারি, তা করা যায়। প্রতিবাদ করা যায় যখন-তখন। এটার তো একটা দাম আছে। এটা তো আর চলবে না, এটা তো ভারতের অন্য শহর দেখেই বুঝতে পারছি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মমতা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধী। সবকিছুতে তাঁর একটা সহনশীল প্রতিক্রিয়া আছে। দার্জিলিংয়ের বিমল গুরুং থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী—সবাইকে নিয়ে চলার একটা চেষ্টা তিনি করছেন তাঁর মতো করে। ভারতের আজকের রাজনীতিতে এটাও কম কথা নয়। দলিত, নমঃশূদ্র, আদিবাসী—যেখানেই কিছু দিতে পারছেন, দিচ্ছেন। তাঁর চেষ্টা হলো, ধার করে যা পারব দেব, কিন্তু কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াইটা চালিয়ে যাব। এটা তো সেই ঐতিহাসিক বারো ভূঁইয়ার লড়াই—মোগল আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে বৃহত্তর বাংলার বারো ভূস্বামী–সেনাপতির লড়াই। এ লড়াই দিল্লির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। হিন্দু, মুসলিম, দলিত, আদিবাসী, পাহাড়ি, জনজাতি—সবাইকে এক করে করে পাঁচ শ বছর পরে দিল্লির বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য এক লড়াই লড়ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ তো আমাকে সেই হোসেন শাহিদের রাজত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এটা অনেকটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লড়াইকেও মনে করিয়ে দেয় বাইরে থেকে আসা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
বাংলায় যে বাইরের লোক আসবে না, তা তো নয়। বাংলায় বরাবরই বাইরের লোক এসেছে, থেকেছে। বাংলায় যে আছে, সে–ই বাঙালি।
কিন্তু বাইরে থেকে আসা লোক বা বহিরাগতদের ঠেকাতে হবে এখানকার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে। কমিউনিস্টরা এটা অন্যভাবে মধ্যবিত্তদের সঙ্গে নিয়ে, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নিম্নবর্গের পরিচয়টাকে সঙ্গে নিয়ে করার চেষ্টা করেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন।
একদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অর্থের জোর, অন্যদিকে আদিবাসী ও দলিতদের বিজেপিতে যাওয়া—এই সবই বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে।
মমতা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধী। সবকিছুতে তাঁর একটা সহনশীল প্রতিক্রিয়া আছে।
বামপন্থী আর কংগ্রেসদের ভূমিকা দুঃখজনক।
সব বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দল—বামপন্থী, কংগ্রেস, তৃণমূল একসঙ্গে আসতে পারলে ভালো হতো।
রণবীর সমাদ্দার: ঠিক। মমতা যে সাংগঠনিকভাবে বিরাট ভুল করেছেন, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তৃণমূল সিপিআই–এমের মতো সংগঠনকেন্দ্রিক পার্টি হবে, এটা আশা করা তো ভুল, সোনার পাথরবাটি। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসনের পর যখন সিপিআই–এমে বড় ধরনের সংকট এল, সঙ্গে সঙ্গে সেটি ভেঙে পড়ল, অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো। বড় বিপর্যয় এলে সংগঠন বিশেষ কাজ দেয় না। শুধু সংগঠন দিয়ে এ ধরনের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা যায় না। আর এ রকম সাংঘাতিক আগ্রাসী, দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী শক্তি বামপন্থীরা অতীতে দেখেননি।
উল্টো দিকে তৃণমূলের রাজনীতি অদ্ভুত। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ এসেই চলেছেন। এটা কি রাজনৈতিক দল? এর তো কোনো মাথামুণ্ডু নেই। ‘মা মাটি মানুষ’—মা দিয়ে যা কিছু জুড়ে দাও...একটি বিমূর্ত আদর্শ নিয়ে সবাইকে এক করে লড়াই করে চলেছেন। তৃণমূল সরকারটা কী? গরিব মানুষকে দেওয়ার একটা রাজনীতির সরকার। রিকশাওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা, মজুর, মুটে, রাস্তার ধারে থাকা মানুষ, এই বিশ্বায়নের সুফল যারা পায়নি—তৃণমূল পার্টির জন্ম দিয়েছে তারাই। সে জন্য এর কোনো নীতি নেই সেই অর্থে। মানুষ যা চায়, তাই তাকে দাও। আর এটাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নজর দিয়েছেন। সরকার দিয়ে যতটা পারবে দেব, এভাবেই তারা ভাবে। এটা করলে সংগঠন উপেক্ষিত হবে। কারণ, দুটো মমতা তো আর নেই। তৃণমূল সংগঠনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা একটা দল নয়। সেই জন্য এ দলের কোনো নীতি নেই, সেটা হতেও পারত না। শুধু রাজনীতি দিয়ে মানুষকে এই পরিষেবা দেওয়া যেত না।
আবার উল্টো দিকে এমন একটা সময়ে সাংঘাতিক কেন্দ্রীভূত, হিন্দুত্ববাদী, নয়া উদারতাবাদী, প্রোটো–ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায়। সমাজের একটা পরিবর্তন হচ্ছে। সমাজ, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি—সবই পরস্পরকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এমন তো নয় যে সমাজটা আগে সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়, আর তারপরে রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটে। সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত সাম্প্রদায়িকতা বলে তো কিছু হয় না। সবাই আসলে সবাইকে ধরে বেড়ে ওঠে—সমাজ, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা। ফলে এখানে দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী, নিও লিবারেল শক্তির সঙ্গে এটা পপুলিজমের রাজনীতির একটা লড়াই হচ্ছে।
এখন তৃণমূলের একটা আদর্শ থাকলে কী হতো? ওরা বলতে পারত, এটা তোমার সরকার, তোমাকে বাঁচাতে হবে। আদর্শ না থাকার কারণে সেটা তারা বলতে পারছে না। কিন্তু মমতা লড়ছেন। কত দিন পারবেন, বলা মুশকিল। কারণ, এটা সেই তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার লড়াই। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দু–একবার জেতা যায়। মমতা পারেন কি না, সেটা দেখা যাক।
রণবীর সমাদ্দার: এখনো তৃণমূল এখানে এগিয়ে এবং সেটা নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। এই যে সংসদীয় রাজনীতি, এখানে জিতেও যদি দেখা যায় ৩০–৪০টা আসনে তৃণমূল এগিয়ে, তাহলেও তারা টিকে থাকতে পারবে কি না সন্দেহ। কারণ, অন্য রাজ্যে আমরা দেখেছি বিধায়কদের কীভাবে কেনাবেচা চলছে। এখানে যদি সব বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দল—বামপন্থী, কংগ্রেস, তৃণমূল একসঙ্গে আসতে পারত, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা তো হলো না। বামপন্থী আর কংগ্রেসদের ভূমিকা অত্যন্ত দুঃখজনক। তৃণমূলকে হারাতে এরা উঠেপড়ে লেগেছে। এটা তাদের বা রাজ্যের জন্য ভালো কি না, ভবিষ্যৎই সেটা বলবে। তবে মমতাই এখনো রাজ্যের প্রধান মুখ। বিজেপির বিশাল একটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটা মূলত তাই তাঁরই সঙ্গে।
রণবীর সমাদ্দার: হ্যাঁ, সেটাই। কারণ, চাপটা নানা স্তরে দেওয়া হচ্ছে। তবে এই যে দল থেকে লোক বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা ভালোই হচ্ছে। এ ধরনের শুদ্ধকরণ ছাড়া পার্টি বাঁচে না। এটা চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব থেকে এ দেশে কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টি—সর্বত্রই দেখা গেছে। এমনকি এই যে পুরোনো বিজেপির জায়গা নিয়ে নিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন নতুন বিজেপি, সেটাও তো তেমনই। সে বিচারে আখেরে এটা তৃণমূলের জন্য ভালোই হচ্ছে বলে আমার ধারণা।
শুভজিৎ বাগচী: আপনাকে ধন্যবাদ।
রণবীর সমাদ্দার: ধন্যবাদ।
Date published: ২২ জানুয়ারি ২০২১, ১৩: ২৮
Author: শুভজিৎ বাগচী
Entry Type: ইন্টারভিউ
Source: https://www.prothomalo.com/world/%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8B-%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%81%E0%A6%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%9B%E0%A7%87