যুক্তরাজ্যের ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়'এর রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক হিউ টিঙ্কার ১৯৮২ সালে প্রখ্যাত "হিস্টোরি টুডে" ম্যাগাজিন'এ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিবসকে সামনে রেখে Death of Rabindranath Tagore প্রবন্ধটি রচনা করেন। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রবন্ধটি বাংলায় অনুদিত হলো।
আমরা ইতিমধ্যে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে “পরিবর্তনহীন প্রাচ্য" ধারণাটা যতটা না উন্মোচন করে, তার চেয়ে অনেক বেশি আড়াল করে। একই ভাবে, এশীয় প্রেক্ষাপটে ভিক্টোরিয়ান প্রগতির ধারণা বা আমাদের নিজের উন্নতির ধারণা যা মূলত একটা "আধুনিক" বস্তুবাদিতাকে চিত্রায়িত করে, সেটাও সমানভাবে অকার্যকর। এই ভ্রমটিই ভারতীয় এক চিন্তাবিদ বুঝতে পেরে লিখেছিলেন-
প্রগতিকে লক্ষ্য দিয়ে বিচার করতে হবে। ট্রেনের প্রগতি হয় একটা স্টেশন থেকে আরেকটা স্টেশনের দিকে- এটা চলন। কিন্তু একটা বৃক্ষের এমন কোনো প্রগতি হয় না। বৃক্ষের প্রগতি অন্তর্মূখী, বৃক্ষের প্রগতি জীবনের উন্নয়ন। বৃক্ষ বাড়ে, বৃক্ষের বৃদ্ধি হয় তার পাতায় আলোর সঞ্চারে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, তার বৃদ্ধি হয় তার নিঃশব্দ নির্যাসে। (Nationalism in Japan, Nationalism, 1917)
এই
চিন্তাবিদ, সম্ভবত আধুনিক সময়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম সন্তান; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ,
তিনি কখনোই নিজেকে ভারতের একান্ত ভাবেন নি। তিনি নিজেকে দেখতেন তাঁর দেশজ বিচারে- বাংলার
সন্তান হিসেবে, আর বৃহত্তর চিন্তায় মানবসন্তান হিসেবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে পরিবর্তনের
সাথে খাপ খাওয়ানোকে আমরা যে আধুনিকতা ভাবি, তাঁর পরিবার যেন তা-ই করেছে। কবি, তাঁর
পিতার মতো, এমন আরোপিত চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের করায়ত্তে থাকা
ভারতবর্ষে শুরু হওয়া অস্থিরতার একটা সার্বজনীন উত্তর খুঁজছিলেন।
কবির
পূর্বপুরুষরা প্রাচীনকাল থেকেই নদী আর ধানক্ষেতের দেশ 'বাংলা'র বাসিন্দা। তাঁরা ছিলেন
ব্রাহ্মণ; আর মধ্যযুগীয় ইউরোপের পাদ্রীদের মত তাদের ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্যের উপর
একচ্ছত্র আধিপত্য। যখন মুসলমানেরা বাংলায় শাসন শুরু করলো দ্বাদশ শতাব্দীতে, এসকল শিক্ষিত
ব্রাহ্মণদের তারা উচ্চপদে চাকুরীতে নিযুক্ত করতে শুরু করলো। কেউ কেউ মুসলমান গভর্নরদের
সান্নিধ্যে এসে মুসলমানদের খাবারের সুগন্ধের অনৈচ্ছিক গ্রহীতা হয়েছিলেন, এমনকি আমিষ
খাবারেরও। এভাবে তারা তাদের হিন্দু বর্ণপ্রথা প্রাপ্ত উচ্চাবস্থান হারিয়েছিলেন। এভাবেই
হয়তো তাদের গোঁড়ামি কমে এসেছিল, হয়তো তারা নিজেদের কঠোর নিয়মের বাইরে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
কারণ যখন ব্রিটিশরা বাংলায় আসলো, এসব ব্রাহ্মণদের বংশজরা ব্যবসার কাজে হুগলীর বৈদেশিক
বানিজ্য কেন্দ্রে আবাস গড়েন, যা কালানুক্রমে কলকাতায় স্থানানরিত হয়।
এ
এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, আর তারা এসব ব্রাহ্মণদের যথাযথ
সম্মান প্রদর্শন করে ঠাকুর উপাধি দিয়েছিলেন। এ নবাগতরা খুব জলদিই ব্যবসার নিয়মনীতির
সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন, আর পরে যখন ব্রিটিশদের সাথে তাঁরা ব্যবসা শুরু করেছিলেন
তখন ব্রিটিশরা- যারা ভারতীয় ভাষাকে বিকৃত না করে কিছুই উচ্চারণ করতে পারতো না- এদের
'টেগোর' নামে ডাকতে লাগলো। প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে 'টেগোর'রা এই অঞ্চলকে একটি বানিজ্য
নগরীতে পরিণত করতে অবদান রেখেছিলেন। ব্রিটিশরা থাকতো দক্ষিন কলকাতায়, চৌরঙ্গীতে, ভারতীয়দের
স্থান হয়েছিল উত্তরের “ব্ল্যাক টাউন”এ। ঠাকুরররা এখানেই তাদের পারিবারিক বাসভবন নির্মান
করেন, জোড়াসাঁকো, যেখানে তাদের পরিবার বেড়ে চলে। প্রায় সব ধনিক বাঙালি ঘরের মতোই, ঠাকুরদের
বাড়ির মাঝেও ছিল উঠান, আর চারদিকে ছিল বাড়ি, আর এক পাশে উঁচু মঞ্চ। এসব মঞ্চ ভিক্টোরিয়ান
যুগের থিয়েটারের আদলে বানানো হতো, আর এর কাজও এক প্রকার নাটকীয়ই ছিল, কারণ এখানে পূজাপার্বণে,
মৌসুমী উৎসবে নাচ, গান, আবৃত্তি হতো।
ঠাকুর
পরিবারের অর্থযশ চূড়ায় পৌঁছায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের (১৭৯৪-১৮৪৬) সময়ে। সুদর্শন, প্রাজ্ঞ,
কর্মঠ দ্বারকানাথ ব্রিটিশদের সাথে যুক্ত হন যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বার্মার ছড়ি থেকে
শুরু করে আফগান পাহাড় পর্যন্ত বিস্তার পেয়েছিল। একই সময়ে ব্রিটিশদের শাসনের সুবাদে
ভারতবর্ষে শিল্প বিপ্লবের সুফল আসতে শুরু করেছিল। বিনিয়োগের সুযোগের এই সূবর্ণকালে
দ্বারকানাথ চিনি, চা, নীল, আর ভারতবর্ষের প্রথম কয়লা খণিতে বিনিয়োগ করেন। দ্বারকানাথের
ছিল একটা নৌবহর, আর তিনি ভারতবর্ষে প্রথম আধুনিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ভারতের অর্থনীতিতে
সরব ভূমিকা রাখেন। সকল উদ্যোক্তাদের মতো দ্বারকানাথও বিনিয়োগে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, অনেক
ক্ষেত্রে দূর্দান্ত ক্ষতি আর অনেক ক্ষেত্রে লাভবানও হয়েছিলেন। তবে তিনি ব্যর্থতাকে
ঘৃণা করতেন। তাঁর জীবন ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। তিনি ইউরোপিওদের আপ্যায়ন করতেন এমন ভাবে যা
অন্যদের জন্য ছিল কল্পনা। তাঁর অতিথিদের মধ্যে ছিলেন এমিলি ইডেন, গভর্নর জেনারেলে বোনতূল্য
মানুষ তিনি। দ্বারকানাথ শুভ কাজে দান করতেন, তিনি শিল্পানুরাগী ছিলেন। তাঁর সমকালীন
লোকেরা তাঁকে "প্রিন্স" দ্বারকানাথ ডাকতেন। তাঁর অন্যতম সহচর ছিলেন বাঙালি
রেনেসাঁর রূপকার রাজা রাম মোহন রায়। রাম মোহন ছিলেন ধর্ম সংস্কারক, আধ্যাত্মিকতা আর
সামাজিক পরিবর্তনের মাঝামাঝি পথ খোঁজার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত, বিংশ শতকে যার ফলাফল
ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। রাম মোহন স্থবির, বর্ণপ্রথায় জর্জরিত, ধর্মগ্রন্থের আবৃত্তি
সর্বস্ব হিন্দু সমাজের শবে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন উপনিষদ, খ্রিষ্ট ধর্মের সহমর্মী
ঈশ্বর, আর ইসলামের একত্ববাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহাসত্য। প্রোটেস্টান্ট মিশনারীরা
ভেবেছিলেন রাম মোহন রায় আর তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা বোধ হয় খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে ফেলবেন,
তারা কিছু পূজা অর্চনার শুরু করেছিলেন যেখানে তারা একত্ববাদের কাছাকাছি দর্শন নিয়েই
কাজ করতেন। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাম মোহন সতীদাহ প্রথা এবং উচ্চ বর্গীয় ব্রাহ্মণের
বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কাজ করেছিলেন। একই সময়ে তিনি তাঁর চিরায়ত সংস্কৃতির
অন্যান্য অঙ্গনকে পূনর্জাগরনের কাজও করেছিলেন,
যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলা ভাষাকে সাহিত্য, ধর্ম এবং সামাজিক সংস্কারের ভাষা হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করাকে উৎসাহ দান করা। শতাব্দিব্যাপি মুসলমান শাসনামলে ফারসি ও আরবির প্রাধান্যে
বাংলা ভাষা ছিল অবহেলিত। যুবসমাজে বাংলার চেয়ে ইংরেজির বেশি মূল্য ছিল কারণ তারা ভাবতো
ইংরেজিই আধুনিক জগতে প্রবেশ করার পথ। রাম মোহন বাংলায় সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য রচনাকে
প্রচার করতেন।
এসবের
মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ রাম মোহন রায়কে তাঁর অর্থ এবং প্রভাব দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
তাঁরা মিলে Calcutta Unitarian Committee আর হিন্দু কলেজ (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজ)
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে বর্ণপ্রথা মুক্ত পরিবেশে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের
শিক্ষাদান করা হত। রাজা রাম মোহন রায় চেয়েছিলন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বুঝিয়ে এই অঞ্চলকে
প্রগতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে। সরকারের নতুন হুকুমনামা অনুযায়ী ভারতবর্ষ থেকে হাউজ অফ
কমন্সে রাম মোহন রায় প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময়ে কোনো উচ্চবর্গের হিন্দু
সমুদ্র পার করায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, যদি কেউ তা করে তবে তার জাত চলে যাবে! রাম মোহন এই
নিষিদ্ধ যাত্রা করেন, আর ইংল্যান্ডে গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সাথে সাক্ষাত করেন, কিন্তু
তিনি ১৮৮৩ সালে ব্রিস্টলে মারা যান, আর তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা হয়।
দ্বারকানাথও
এই নিষিদ্ধ যাত্রার ব্যাপারে মনস্থির করেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত তিনজন তরুণ বাঙালীকে
নিয়ে যান ব্রিটিশ মেডিকেল স্কুলে পড়াতে (তারাই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইউরোপের মেডিকেল
শিক্ষা নিয়েছিলেন)। ব্রিটেনে তাঁকে সম্ভাষণ জানাতে রাণী ভিক্টোরিয়া আর ব্রিটেনের হর্তা-কর্তারা
আসেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনও ছিল রাজসিক, এবং দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর ভাতিজা এবং ছোট ছেলেকে
নিয়ে ব্রিটেনে যান। তারা সেখানে দুই বছর অবস্থান করেন, কিন্তু দ্বারকানাথ অসুস্থ হয়ে
পড়েন, এবং লন্ডনে আগস্ট ১৮৪৬ সালে, মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
দ্বারকানাথের
উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান দেবেন্দ্রনাথ (১৮১৮-১৯০৫) তাঁর পিতার ব্যবসা
সামলানোর দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনি তাঁর পিতার মত ব্যবসায়শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন না।
আর তাই তিনি ব্যবসায় জগতকে বিদায় জানান। তবে, দ্বারকানাথ পূর্ব-বাংলা এবং পশ্চিম বাংলায়
ব্যাপক ভূমি-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, আর উত্তরসূরি হিসেবে দেবেন্দ্রনাথও এই পরম্পরা
বজায় রেখেছিলেন। দ্বারকানাথ দেশীয় ভদ্রলোকী জীবন আর আধ্মাত্যিকতার মিশেলে জীবন গড়তে
চেয়েছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ পরম্পরা হিসেবে সেটাকে ধরে রেখেছিলেন। ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ
রাম মোহনের ব্রাহ্ম সমাজের পূনঃর্প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজ একেশ্বরবাদীতায়
বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রাহ্মরা ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালী। যদিও তারা বর্ণপ্রথার ঘোর
বিরোধী ছিলেন, এবং প্রতিমা পূজাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন, তবুও তাঁরা হিন্দু সংস্কৃতিকে
আর রীতিনীতিকে মেনেই চলতেন। দেবেন্দ্রনাথকে একজন সংস্কারক বলাই যায়। তিনি একটি উচ্চবিদ্যালয়
স্থাপন করেন যা মিশনারীদের স্কুলের সমপর্যায়ে শিক্ষাদান করতো, কিন্তু সেখানে শিক্ষার
মাধ্যম ছিল বাংলা। তিনি একটি বাংলা পত্রিকার শুরু করেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামে,
যা মিশনারীদের অপপ্রচারের জবাব দিতো এবং বাঙালীদের বিবেকবোধ আর চৈতন্যকে উন্নত করার
চেষ্টা করতো। ব্রাহ্ম সমাজের মধ্য থেকে (যাদের মোট সংখ্যা কখনো কয়েক হাজারের বেশি ছিল
না) ভিক্টোরিয়ান ভারতীয় অভিজাতদের সিংহভাগ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বিচারক, অধ্যাপক,
সম্পাদক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী আসতে শুরু করলেন- যারা ভবিষ্যৎ ভারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
করেছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি লিখতেন, বক্তব্য দিতেন, যার
সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল ঈর্ষনীয়, যিনি ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন রেলে আর নৌযানে, এত কিছুর
পরও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে নিভৃতচারী ছিলেন। তিনি জাগতিক সকল মোহ ছেড়ে দিয়ে নির্জনে
ঈশ্বর সন্ধান করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে বীরভূম আর ভোলপুরে কিছু নির্জলা,
বন্ধ্যা জমি। এখানেই তিনি দু মাইলের ধূলা ওড়া পথ পেরিয়ে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন, যেখানে
তিনি আম্রকানন সাজিয়ে শান্তিনিকেতন বানিয়েছেন। তিনি এ বাড়িতে একটি মন্দির বানিয়েছেন
যার অনুপ্রেরণা হয় ছিল ক্রিস্টাল প্যালেস, কারণ এটা বানানো হয়েছিল ইস্পাত দিয়ে আর দেয়াল
জুড়ে বসানো হয়েছিল রঙিন কাঁচ। এই মন্দিরে কোনো প্রতিমা ছিল না, এখানে মুসলিম আর খ্রিষ্টানরাও
আসতে পারতো।
দেবেন্দ্রনাথের
মহৎ কাজের প্রতিদান হিসেবে তাঁকে মহর্ষি উপাধি দেয়া হয়েছিল। তিনি গৃহসংসার ত্যাগ করে
সন্ন্যাস নিয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত তা করেন নি। তিনি
গৃহকর্তা হয়ে, একান্নবর্তী পরিবারে তাঁর ১৫ সন্তান নিয়েই বেঁচেছিলেন। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ
সন্তানের অগ্রজ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার জন্ম হয়েছিল ১৮৬১ সালের মে মাসে। তাঁর
নাম সূর্যের মহত্বকে ইঙ্গিত করে। রবির ছোট বেলা কেটেছে জোড়াসাঁকোর উঠান-বারান্দায় আর
তাঁর শিক্ষা হয়েছিল তাঁর মাতৃভাষা বাংলায়। দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ
ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ভারতের অভিজাততম চাকুরিতে যোগদান করার
সুযোগ পান। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি সর্ববিট্রিশ সার্ভিসে ভর্তি হন, যা মূলত গঠিত
হতো অক্সফোর্ড আর কেম্ব্রিজের সেরাদের সেরা ছাত্রদের নিয়ে। ১৮৭৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ
তাঁর পরিবারকে ব্রিটেনে নিয়ে যান। রবীন্দ্রও তাদের সাথেই যান। লক্ষ্য ছিল তাঁকে ইংরেজি
শিক্ষা দিয়ে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ঢুকানো, অথবা যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে আইনজ্ঞ বানানো।
এ লক্ষ্যে তাঁকে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি করানো হয়। রবীন্দ্র সুপুরুষ ছিলেন,
যা তাঁর বার্ধক্যেও আমরা দেখতে পাই। লম্বা, সুঠাম গড়ন, লম্বা চুল, আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,
তিনি ছিলেন তরুণী যুবতীদের জন্য আকর্ষনীয়। হয়তো এমন জনপ্রিয়তা তাঁর জন্য হীতে বিপরীত
হয়ে পড়েছিল, কারণ ১৮ মাস পরেই তিনি ভারতে ফিরে
আসেন কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন ছাড়াই। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান,
শেক্সপিয়ার, উইলিয়াম স্কট, ডিকেন্স- আর বাইবেল (তাঁর নিজের সংগ্রহে থাকা বাইবেল থেকে
তা-ই প্রমাণিত)। ইংল্যান্ড থেকে ফেরত আসার সময় তাঁর প্রথম গীতিনাট্য 'ভাঙা হৃদয়' এর
পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসেন।
শিশুকাল
থেকেই রবীন্দ্র কবিতা এবং নাটক লিখতেন। এখন সে কবিতা আর নাটকে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
ঠাকুর পরিবারের সবাই শৈল্পিক ছিলেন, আর রবীন্দ্রের সৃষ্টিই তারা জোড়াসাঁকোর মঞ্চে উপস্থাপন
করতেন। ধীরে ধীরে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলেও রবীন্দ্রের সৃষ্টি সমাদৃত হতে শুরু করেছিল।
এই যুগে বাংলা সাহিত্য ভারতের আঞ্চলিক সাহিত্যের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল,
আর কলকাতায় ইংরেজি সাহিত্যের সাথে সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে টক্কর দিতে পারছিল। তৎকালীন
সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) যিনি খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত
হয়েছিল আর যিনি ছিলেন বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দ নাট্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, আরো ছিলেন
বঙ্কিম চন্দ্র চ্যাটার্জী (১৮৩৮-৯৪), তিনি ছিলেন উপন্যাসিক। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আনন্দ
মঠ, যার পটভূমি ছিল ব্রিটিশদের দ্বারা ভারত বর্ষে মুসলিম শাসনের উৎখাত (যাদের মুক্তিদাতা
ভাবতো বাঙালি হিন্দুরা)। এই গ্রন্থে একটি দেশাত্মবোধক গান ছিল 'বন্দে মাতরম' যা অনানুষ্ঠানিকভাবে
ভারতের জাতীয় সংগীত হওয়ার কথা ছিল। বঙ্কিমের জীবনের শেষ যুগে তিনি বাংলার ভবিষ্যতের
সারথি হিসেবে রবীন্দ্রকে স্বীকৃতি এবং প্রশংসা করেছেন।
রবি
কলকাতার আভিজাত্যে ডুবে যান নি। তাঁর পিতা, যিনি নিভৃতচারী ছিলেন, তাঁকে পূর্ববাংলায়
(বর্তমান বাংলাদেশ) তাদের সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। গ্রাম্য জীবন রবীন্দ্রের
মানসে বিস্তর প্রভাব ফেলে। তিনি বাংলার লোক সাহিত্যের জন্য গভীর আকর্ষণ বোধ করেন, বাউলদের
গানে তিনি উদ্বেলিত হন। তিনি বাংলার নৈসর্গিক ভূদৃশ্য আকণ্ঠ পান করেন, পদ্মা নামের
বজরায় ঘুরে বেড়ান, সে পদ্মা যা সোনার বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য্য আর পবিত্রতার প্রতীক।
নিয়ম
অনুযায়ী রবীন্দ্রের স্ত্রী নির্বাচন করেন তাঁর পিতা, তিনি তাঁর পূর্ববাংলার জমিদারির
এক কর্মকর্তার মেয়েকে নিজে পুত্রবধূ বানাবেন বলে ঠিক করেন। মেয়েটি রূপ বা শিক্ষার দিক
থেকে খুব আহামরি কিছু ছিলেন না। বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৮৮৩ সালে। সম্পর্কের এমন আশ্বাসহীন
সূচনা থেকেও প্রেমের জন্ম হয়, তবে এর আগেই রবি এক দারুণ মানসিক আঘাতের সন্মুখিন হয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রবি সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী, যিনি রবি'র প্রায় সমবয়সীই ছিলেন,
তার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। রবির বিয়ের পাঁচ মাস পরে ঐ নারী আত্মহত্যা করেন।
এই ছিল রবির জীবনের প্রথম ব্যক্তিগত ট্রাজেডি। তিনি এই ট্রাজেডি ফলস্বরূপ, পরিত্যাগ
করেন সকল বিলাসিতা, নিজের সেই রাজকীয় আলখেল্লা, যাতে তাঁকে লাগতো যিশুখ্রিস্টের মতো।
তিনি অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন, যা থেকে তাঁর কাজ তাঁকে শান্ত করেছিল; আর তিনি আবারও
কালজয়ী কবিতা, নাটক আর উপন্যাস লিখতে শুরু করেন।
বেলা,
তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা, জন্ম নেয় ১৮৮৬ সালে, রবি ছিলেন চার সন্তানের স্নেহময় পিতা, কিন্তু
পরিবারের প্রতি তাঁর টান ছিল না কখনোই। ১৮৯০ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ড যান, তবে আকস্মিকভাবে
ফিরে আসেন। ব্যাপারটি পরবর্তীতে বাংলায় তিনি লিখেন, যেখানে তিনি শহুরে, শিল্পায়িত সমাজের
সমালোচনা করে লিখেন-
বড়াে বড়াে বাড়ি, বড়াে বড়াে কারখানা, নানা আমােদের জায়গা। লােক চলছে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে, খুব একটা সমারােহ। সে যতই বিচিত্র যতই আশ্চর্য হােক-না কেন, তাতে দর্শককে শ্রান্তি দেয়; কেবলমাত্র বিস্ময়ের আনন্দ চিত্তকে পরিপূর্ণ করতে পারে না, বরং তাতে মনকে সর্বদা বিক্ষিপ্ত করতে থাকে। (য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারী, পর্ব ২, ১৩০০ বঙ্গাব্দ।)
তাঁর
লেখায় ভারতের অতীত ইতিহাসে অনুপ্রেরণা খোঁজার প্রবণতা বাড়তে থাকে, যদিও তাঁর লেখ্য
বিষয় বর্তমান এবং অতীত দুই কালের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, আর তাঁর লেখায় সামাজিক পরিবর্তন
আর অনেকক্ষেত্রে হাস্যরসও পাওয়া যেত। বৃদ্ধ পিতার চাপে তিনি তাঁর মধ্যবয়সে কিছু সামাজিক রীতি মেনে নিতে
বাধ্য হয়েছিলেন বলে মনে হয়, কারণ তিনি তাঁর কন্যাদের বিয়ে ঠিক করেছিলেন ১১ বছর এবং
১৪ বছর বয়সে, যদিও তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি গ্রামের সৌন্দর্য্য আর
শহরের চাকচিক্যের মধ্যকার পার্থক্যকে বেশি বেশি উপলব্ধি করতে শুরু করেন। ১৯০১ সালে
তিনি শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপন করেন যাতে ছাত্র সংখ্যা ছিল পাঁচ, যার মধ্যে তাঁর
পুত্র রথীন্দ্রনাথও ছিলেন। কোনো পরীক্ষা, বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোনো চাপ ছিল
না এখানে, এটি বানানো হয়েছিল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। সংগীত, নাট্য, চিত্রকর্ম,
ইত্যাদিতে বেশি জোর দেয়া হতো। এই বিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে বের
করে আনা, সরকারী চাকুরির জন্য প্রার্থী বানানো না।
রবীন্দ্রের
এই জীবনে বাধ সাধে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত। এই প্রদেশ ছিল বড় এবং
জনবহুল, প্রায় ৮ কোটি লোকের বাস ছিল এখানে। বিভাজন যদিও প্রশাসনিক সমস্যাকে সমাধান
করতে পেরেছিল, কিন্তু এতে রাজনীতি সচেতন বাঙালীরা অসন্তোষ দেখান। এই সময়ে বন্দে মাতরম
হয়ে উঠে প্রতিবাদের সুর। রবীন্দ্রও এই সময়ে দেশাত্মবোধক গান লিখতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন,
আর তা মানুষকে গেয়ে শোনান। ব্রিটিশরা তাঁকে উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে বিবেচনা
করে, যদিও তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল পুরোটাই সাংস্কৃতিক। তাছাড়া উচ্চ প্রশাসনিক পদে অধিক
সংখ্যক ভারতীয়কে সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাবী বিষয়ক কোনো ভূমিকাই
তিনি রাখেননি। রবীন্দ্রের কাছে এসবই ছিল ব্রিটিশ শাসনের মতোই অচেনা, অজানা। তাঁর রাজনীতির
ধারণা ছিল বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রসার। স্বভাববশতই, তিনি যখন একজন খ্যাতিমান অতিথি
হিসেবে নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেখানকার 'অতিথি বই'তে তিনি নিজের জাতীয়তা
হিসেবে “ভারতীয়” পরিচয় না লিখে, লেখেন “বাঙালী”।
ভারতের
ব্রিটিশ শাসকদের সন্দেহের জন্ম দেয়া ঠাকুর একই সময়ে ব্রিটেনেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
উইল রথেনস্টাইন নামের এক তরুণ চিত্রশিল্পী ভারতে আসেন, তিনি রবীর সাথে দেখা করে তাঁর
একটি চিত্র আঁকেন। উইল রবীকে তাঁর কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করতে বলেন।
তাদের এই বন্ধুত্ব রবীর আরেকটি ইংল্যান্ড সফরকে ত্বরান্বিত করে। গীতাঞ্জলীর ইংরেজি
অনুবাদ প্রকাশিত হয়, প্রথমবার সীমিত পরিসরে, 'ইন্ডিয়া সোসাইটি অফ লন্ডন' দ্বারা, পরবর্তিতে
ম্যাকমিলান দ্বারা। উইলিয়াম বাটলার ইয়িটস রবীন্দ্রনাথের রচনার ভূয়সী প্রশংসা করেন,
তবে ইয়িটস দাবী করেন এই অনুবাদের পেছনে তাঁর অবদান রয়েছে, যার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া
যায় না। গীতাঞ্জলী রচিত হয়েছে গদ্যের মতো, যেখানে অমিত্রাক্ষর ছন্দকে আলাদা আলাদা স্তবকে
ভাগ করার বিষয়টি নেই, যা ইয়িটসের নিজস্ব কবিতার ধরণের চেয়ে ভিন্ন। তবে তিনি ইংল্যান্ডের
মানুষের কাছে এসব রচনা তুলে ধরেছেন, এক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে
পারে, তিনি রথেনস্টাইনের হ্যাম্পস্টেডের বাড়িতে এই রচনা এজরা পাউন্ড, এলিস মেয়নেল আর
আর্নেস্ট রাঈসের উপস্থিতিতে পাঠ করেন। কবি (রবীন্দ্রনাথ) এদের সকলকে অগ্রাহ্য করে দিল্লীর
এক অচেনা মিশনারী ক্রিস এন্ড্রুসের সাথে দেখা করতে চলে যান।
আচমকা
পাওয়া খ্যাতিতে অনেকেরই যা হয়, ঠাকুরও তেমনি একই সাথে কৃতজ্ঞ কিন্তু কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন।
লন্ডনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হবার পরে তিনি রথেনস্টাইনের বাড়ি বা এন্ড্রুসের স্ট্রাটফোর্ডশায়ারের
যাজকগৃহে আকরকম আশ্রয়ই নিয়েছেন। যখন তিনি ভারতে ফিরে এলেন তখন জানতে পারলেন যে তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল
পুরষ্কার পেয়েছেন। সাহিত্যে নোবেলের শুরু হয় ১৯০১ সালে, রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৯০৮ সালে
নোবেল পান, আর ইয়িটস ছিলেন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে দ্বিতীয় নোবেল জয়ী, যিনি ১৯২৩ সালে
নোবেল পেয়েছিলেন।
টেগোর
(কারণ তিনি তদ্দিনে আর বাংলার ঠাকুর না, বিশ্বের টেগোর) পশ্চিমের সমসাময়িক যে বর্ণিল,
নতুন ধারা, তা ধরতে পেরেছিলেন; প্রায় একই সময়ে যখন রাশিয়ান ব্যালে আমেরিকা আর ব্রিটেনে
এসেছিল। ১৯১৫ সালের মধ্যে গীতাঞ্জলীর ২০টি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছিল। ভারতের ব্রিটিশ
শাসকরা এই ব্যাপারে অজানাতে ছিল না। ক্রিস এন্ড্রুসের মাধ্যমে তারা টেগোরকে ভাইসরয়ের
সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করালো। ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁকে নাইটহুডের জন্য প্রস্তাব
করেন, ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধিতে ভূষিত হন।
যুদ্ধ
চলাকালে তিনি অস্থির হয়ে পরেন। এ সময়ে তিনি চলে যান জাপানে, যেখানে তাঁকে পশ্চিমাদের পাঠানো এশিয়ার
প্রতীক হিসেবে সম্মান জানানো হয়। জাপানীরা যেটা বুঝতে পারেন নি সেটা হচ্ছে ঠাকুর এশীয়
ভাতৃত্ববোধ এবং আন্তর্জাতিকতার বার্তা নিয়ে জাপানে গিয়েছিলেন। ঠাকুর জাতীয়তাবাদকে* ত্যাগ করেছিলেন,
জাপানীরা তাঁর এই কাজকে ভেবেছিল আত্মসমর্পনের প্রতীক। তিনি তাঁর নিজের দেশে বাড়তে থাকা
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাপারেও উদাসীন ছিলেন। যেমন, তিনি এন্ড্রুসের কাছে চিঠিতে বলেন-
“আমরা, ক্ষুধার্ত মানুষেরা, প্রাচ্যের ছিন্ন শীর্ণকায় লোকেদের দ্বারাই মানবতার মুক্তি
আসবে! আমাদের ভাষায় জাতি বলতে কোনো শব্দ নেই”। তাঁর মতবাদের স্ফটিকিকরণ হয়েছে ১৯১৭
সালে প্রকাশিত বই জাতীয়তাবাদ এ। তিনি তাঁর দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন- “জাতীয়তাবাদের
মধ্যে 'অপর'এর ধারণার অবতারণা করার ফলাফল হিসেবে মানুষের মধ্যে যত শ্রেষ্ঠত্ব আছে তাঁর পতন হবে” ঠাকুর যখন এ কথা লিখছিলেন, উড্রো উইলসন তখন বিশ্বে জাতীয় সার্বভৌমত্বের গুনাগুন
বলে বেড়াচ্ছিলেন।
ঠাকুরের
সবচেয়ে স্মরনীয় কর্মটা হয়েছিল ১৯১৯ সালে। গান্ধী ভারতের উপর আরোপিত শোসনমূলক আইনের
প্রতিবাদ করছিলেন। এই প্রতিবাদ খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, আর গান্ধী আন্দোলন
থামাতে বাধ্য হন, একে তিনি হিমালয়সম ভুল বলে আখ্যা দেন। পরে জানা যায় যে এই প্রতিবাদকে
নিয়ন্ত্রণ করতে জেনারেল ডায়ার অমৃতসরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করে নি।
গান্ধী
এ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। অন্যরা এ ব্যাপারে আলোচনা করতেও চান নি, শুধু ঠাকুর ছাড়া।
ঠাকুর ভাইসরয়কে বলেন-
The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab fop quelling some local disturbances has, with a rude shock, revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India.
ঠাকুর
ব্রিটিশদের দেয়া সম্মানের ব্যাপারে লজ্জিত হন। তিনি ভাইসরয়কে বলেন যেন তাঁকে নাইটহুড
থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
ঠাকুর
মনে নেতিবাচকতা ধরে রাখতেন না, যখন দুই বছর পর গান্ধী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের
অংশ হিসেবে বিদেশী পোষাক ত্যাগ ও প্রজ্বলন করেন, তখন ঠাকুর একে নৈতিক সহিংসতা বলেন।
গান্ধী তাঁকে স্যালুট করে বলেন রবীন্দ্র হচ্ছেন “মহৎ প্রহরী” যিনি তাদের পথ দেখাচ্ছিলেন,
এমন কাজে বাধা দিয়ে যাকে শত্রুরা অসহিষ্ণুতা বলতে পারে। ঠাকুর নিজের উপায়ে এই সমস্যাকে
সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তিনি বিশ্ব ভাতৃত্বের প্রসারের জন্য শান্তিনিকেতনে
বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা ভারতীয় এবং বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য
খোলা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাকুর বলতেন “বিশ্বের নীড়”। দেশি-বিদেশি পণ্ডিত, যেমন
ইউরোপ থেকে সিলভিয়ান লেভি, ফরাসি চীনতত্ত্ববিদ, গিসেপ্পে টুচি, ইতালীয় বুদ্ধতত্ত্ববিদ
ছিলেন প্রমুখ। শান্তিনিকেতনে আরো তিনি একটি কৃষি মহাবিদালয় স্থাপন করে, যেখান থেকে
মানুষ গ্রামীন জীবনের পন্থাগুলো শিখতে পারবে বলে ভেবেছিলেন রবীন্দ্র। তবে তাঁর ভাবনা
মতো কাজ হয় নি। মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা, যতই আদর্শবাদী হোন না কেন, সরকারী চাকরি আর শহুরে
জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারেন নি। যদিও তারা গ্রামাঞ্চলে থাকতেন না, তারপরও তারা শান্তিনিকেতন
থেকে কিছু জ্ঞান লাভ করেছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সত্যজিৎ রায়, কাব্যিক চলচিত্র
লেখক এবং পরিচালক, অধ্যাপক পি সি মহলানবীশ, পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ এবং বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনাকারী,
ও ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ।
জীবনের
পরবর্তী কিছু কাল তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেন, মূলত বিশ্ব ভারতীর জন্য অর্থ সংকুলান করতে।
ঠাকুর এই সময়ে পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ল্যাটিন আমেরিকা, এছাড়াও চীন এবং
সোভিয়েত ইউনিয়নে ভ্রমণ করেন। তাঁর ভিনদেশী বার্তা যে এসব দেশে বেমানান তা তিনি জানতেন।
ইউরোপ তথা পশ্চিমে তাঁর বই বিক্রি হতো ঠিকই,
কিন্তু তাঁর আগের সেই জৌলুস ছিল না। তাঁর প্রাচ্যের বার্তা পশ্চিমে বেশ সাড়া ফেলতে পারে নি। তাঁর বার্তা শেষ হয়ে যায় নি, তাঁর
অক্সফোর্ড বক্তব্য “The Religion of Man” প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত
চিন্তা প্রচারের জন্য তৈরি ছিলেন। যখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁর আমেরিকা
ভ্রমণের কারণ জানতে চান, ঠাকুর তাঁর সফর বাতিল করে দেন, কারণ তিনি তাঁর এশীয়দের পশ্চিমে
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখার চেয়ে
নিজের সফর বাতিল করাকে শ্রেয় মনে করেছিলেন।
জীবনের
শেষ সময়ে ঠাকুর ভোরে উঠতেন দিনের শুরু দেখার জন্য, তিনি নিজের হাতেই লিখতেন। তিনি নিজের
লেখার সম্পাদনায় কোনো কার্পন্য করতেন না, তাঁর পান্ডুলিপি হতে হতো অভিজাত, আর তাই তিনি
তাঁর পান্ডুলিপিতে জটিল নকশা, সাপ, পাখির ছবি আঁকতেন। এভাবেই তিনি তাঁর চিত্রশিল্প
প্রতিভার সন্ধান পান। তাঁর চিত্রশিল্পের তুলনা অন্য কোনো শিল্পী বা চিত্রের ধরণের সাথে
করা যায় না। তাঁর ছবিতে লোক শিল্পের অদক্ষতা ছিল, আর তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির রূপক
এবং উপমা ছিল। ঠাকুরের মৃত্যুর সময় বয়স ছিল ৮০, ১৯৪১ সালে। তিনি তাঁর স্ত্রী, সন্তান
এবং একমাত্রে দৌহিত্রের মৃত্যু দেখেছেন। তাঁর অস্থিরতার মধ্যেও তিনি শান্তিনিকেতনে
নিজের থাকার জায়গা করেছেন, তবে তাঁর ভ্রমণের পরিসীমা কমে মাত্রে কয়েকশ গজে থেমে গিয়েছিল।
তাঁর মৃত্যুর সময়ে তিনি দেখেছেন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ যা তাঁর সারাজীবনের বার্তা আর কর্মের
বিপরীত ছিল (তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অনুরোধ করেন যেন তিনি প্যারিসে জার্মানদের
আক্রমণ থামান, যেন প্যারিস ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচে)। তিনি ভারতের স্বাধীনতা চান এ কারণে
নয় যে তিনি স্বাধীন নতুন দেশ দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এ কারণে যে তিনি বিশ্বাস করতেন
স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই ভারত তাঁর নিজের উত্তারাধিকার বুঝে নিতে পারবে। সকল মহান ব্যক্তির
মতোই ঠাকুরের স্মৃতিকেও তাঁর মৃত্যুর পর বিকৃত করা হয়েছে। তাঁর কবিতাকে দুইটি নতুন
দেশের জাতীয় সংগীত বানানো হয়েছে- ভারত এবং বাংলাদেশ। তিনি জীবিত থাকলে হয়তো এই মহৎ
উৎসর্গের পেছনে থাকা বিদ্রুপকে নিয়ে একটা বলিষ্ঠ ছোট গল্প লিখে ফেলতেন।
* ১৯১৭ সালে প্রকাশিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম মৌলিক ইংরেজি গ্রন্থ 'Nationalism' এ Nationalism বলতে উগ্র/আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (ফেলো, পাভলভ ইন্সটিটিউট, কলকাতা)।
Date published: ১৯৮২
Author: Prof. Hugh Tinker
Entry Type: Review
Source: History Today Archive