Skip to main content

বাঙালি কি বুদ্ধিজীবী-বিরূপ?

বুদ্ধিজীবী-বিরূপতার একটা প্রধান স্থায়ী বৈশিষ্ট্য নতুন একটা কিছুর সম্ভাব্যতার বিরোধিতা। সেটা রাষ্ট্রের দিক থেকে আসতে পারে, আসতে পারে ক্ষমতাবানদের দিক থেকে।




১. 'পাঠক খায়নি'

একটা অতিপুরনো মহাবিখ্যাত গ্রন্থের জীবনে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক গল্প দিয়েই আলাপটা শুরু করা যাক, এই কাহিনীর মাঝে আমার যা কিছু কহতব্য, তার অনেক কিছুই সারসংকলন আকারেই আছে।

হেনরি লুইস মর্গান নৃবিজ্ঞানের জগতে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, 'প্রাচীন সমাজ' নামে এই বিষয়ে তার গবেষণাগ্রন্থটি ছিল যুগান্তকারী। তো এই বইটির কপাল দুই কারণে পুড়েছিল, সমকালে সামান্যই আলোচনা হয়েছিল সেটা নিয়ে, বলা যায় চাপা পড়েছিল।

প্রধান একটা কারণ আমাদের আলোচ্য নয়, তবু সেটা নিয়ে সামান্য বলে রাখা যাক। কারণ এমন প্রবণতা বা জ্ঞানচর্চায় ঘরানাকেন্দ্রিকতা চর্চার বিপদজনক ফলাফল হাল আমলেও সারা দুনিয়াতেই দেখা যায়, আমাদের দেশে তো বটেই। বৃটিশরা এই বইটা নিয়ে আলাপ করেনি, একটা কারণ দেশপ্রেম। একজন মার্কিন তাদের নৃবিজ্ঞান শেখাবে, এটা তাদের জন্য অপমানকর ছিল, সারা দুনিয়ায় বিস্তৃত তাদের সাম্রাজ্যের সূত্রে সব চাইতে দক্ষ তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি তারাই বিকশিত করেছিল, এমনটাই তো ধরে নেয়া যায়। তাদেরকে নৃবিজ্ঞান শেখাবে মার্কিনরা!

মর্গানের উপেক্ষিত হবার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। বৃটিশ বিদ্ব্যৎ সমাজে জন ফার্গুসন ম্যাকলিনান -এর এ বিষয়ক কাজকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হতো, এবং মর্গানের তত্ত্বটি ছিল তার সুস্পষ্ট বিরোধী। প্রথম কারণটির সাথে যুক্ত হয়ে মর্গানের প্রাচীন সমাজ তখনকার দিনের জ্ঞানচর্চার রাজধানী ইংল্যাণ্ডে ও ইংরেজি ভাষায় একদম অবজ্ঞাত হয়েছিল, প্রায় আলোচনাই করা হতো না বইটি নিয়ে। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এ বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, নীরবতার ষড়যন্ত্র দিয়ে সেটিকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিল সুস্পষ্ট। কাঠামোগতভাবেই তারা বইটিকে চাপা দিয়েছিল। ইউরোপ জুড়ে বইটির যে সংস্করণটি চলতো, সেটি জার্মান! ইংরেজি ভাষায় সেটির কোন সংস্করণ ছিল না।

এখানেই আসে মূল প্রশ্নটা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাও তো ইংরেজি, সেখানে কী হলো?

প্রাচীন সমাজ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে, বইটি তেমন বাজার সেখানে আসলে পায়নি, আজকের সম্পাদকীয় পরিভাষায় বললে: পাঠক খায়নি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ১৮৮৮ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পথে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর সাথে একজন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের সাক্ষাত হয়, যিনি লুইস মর্গানকে চিনতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি মর্গান সম্পর্কে এঙ্গেলসকে খুব বেশি কিছু বলতে পারেননি, যদিও জানিয়েছিলেন মর্গান সারাদিন তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবে তার এক ভাই ছিলেন কর্নেল, যিনি ওয়াশিংটনে সমর দফতরে একজন বড় কর্তা ছিলেন। তার মাধ্যমেই মর্গান তার কয়েকটি গ্রন্থ সরকারী খরচে প্রকাশ করাতে পেরেছিলেন। এমনকি এই কংগ্রেসসদস্যও তার প্রভাব ব্যবহার করেছেন মর্গানের জন্য। এসবই দরকার হয়েছিল, কারণ এই বইগুলোর কোন চাহিদা তখনকর মার্কিন সমাজে ছিল না।

বোঝাই যায়, ভাই প্রভাবশালী কর্নেল না হলে, কংগ্রেসম্যান পরিচিত না হলে মর্গানের দশা আরও খারাপ হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞানচর্চার চক্র বা জনগণের মাঝে পড়াশোনার তেমন অভ্যাস না থাকায় এঙ্গেলস যখন তার অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রেও বইটার কোন সংস্করণ বাজারে ছিল না। ইংরেজিতে লেখা মার্কিন আদিবাসীদের নিয়ে মর্গানের গ্রন্থটির সাথে এঙ্গেলস পরিচিত হয়েছিলেন এর একটি জার্মান অনুবাদের সূত্রে।

২, পাঠকে কী খায়?

একটা গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকের সাহিত্যপাতা কমে যাবার কারণ জানতে চেয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। জবাবে তারা জানালেন অমুক গবেষণা সংস্থাকে দিয়ে তারা জরিপ করিয়ে দেখেছেন সাহিত্য পাতা লোকে তেমন পড়ে না। অতএব একদম উপেক্ষা না করা হলেও সেটাকে ছেঁটে দেয়া হয়েছে।

এই গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অর্থহীন। কিন্তু প্রশ্নটা এইখানে, সংখ্যায় কম হলেও দৈনিকের সাহিত্য পাতার একটা পাঠক তো আছেন। বিশেষ করে উঠতি তরুণ পাঠকদের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে একবার নানান বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গল্প-কবিতা পৌঁছে দিয়ে দৈনিকগুলো বলা চলে একটা সামাজিক দায়িত্বই পালন করতো। কোন এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্ধ এবং অদূরদর্শী জরিপের ফলাফল সেটার ওপর করাত চালাতে পারে? কারা করেছিলেন সেই জরিপ? ব্যবসায় প্রশাসনের স্নাতকরা? কাদের মাঝে চালানো হয়েছিল সেই জরিপ? আমার কাছে তো আসেনি সেই জরিপের প্রশ্নপত্র, জানতে চায়নি আমি না পড়লেও প্রতি সপ্তাহে একবার অন্তত চোখ বুলিয়ে জেনে নিতে চাই কিনা ছাপা পত্রিকায় কারা লিখছেন, কী নিয়ে লিখছেন, তর্ক হলো কী নিয়ে, কাদের বাদ দেয়া হচ্ছে দৈনিকে-- সেই সব খোঁজ খবর। বরং জায়গা সংকুচিত হয়ে ছোট্ট কূয়োতে পরিণত হওয়া সাহিত্যপাতায় অন্ধ গোষ্ঠীতন্ত্র, আমলা-কর্পোরেট-ক্ষমতাবান তোষণের রাজনীতিটা এখন বেশি বেশি চোখে লাগে, যদিও সকলেই ক্ষমতাবান বলেই খারাপ লিখবেন এমন কোন নিয়ম নেই।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত বিচিত্রার পুরনো ঈদসংখ্যাগুলোর কথা। মনে পড়ছে তেমনি একটা সংখ্যায় অনেক পছন্দের লেখকের গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি লর্ড মেকওলের লেখা লর্ড ক্লাইভের জীবনীর বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, সেটা এত সুস্বাদু ছিল যে সেটাকে মূল পত্রিকা থেকে কেটে আলাদা করে বাঁধিয়েও রেখেছিলাম। সাথেই ছিল নীরস অন্য একটা বড় প্রবন্ধ, বদরুদ্দীন উমর এর লেখা গণতান্ত্রিক যুবলীগের ইতিহাস। চোখ বুলিয়ে রেখে দিয়েছিলাম, খুব সামান্য কয়েকটা বাক্য মাথায় ঢুকেছিল। কারণ এই জটিল রচনাপদ্ধতি বোঝার মত প্রশিক্ষণের ঘাটতি ছিল। পরবর্তীতে বদরুদ্দীন উমর এর লেখাটা খুঁজে খুঁজে পড়তে হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালী জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ বুঝতে। এই খোঁজার মত জ্ঞানটুকু সম্ভব হয়েছিল বিচিত্রায় তা ছাপা হয়েছিল বলে।

প্রসঙ্গটা এই কারণেই তোলা, একজন দায়িত্বশীল সম্পাদক শুধু পাঠক যা খান, তাই খাওয়ান না। তিনি পাঠককে হাত ধরে পথ দেখিয়ে এগিয়ে আনেন। কোন-দিন-না-দেখা শাহাদাত চৌধুরী তাই আমার প্রিয় সম্পাদক।

এটুকু শিক্ষাই এখান থেকে পাই: জ্ঞানচর্চা নিজের ভরণপোষণ সর্বদা নিজে থেকে নাও করতে পারে। রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা কিংবা এমনকি নিছক ব্যক্তি সম্পাদক, কারও না কারও দূরদর্শীয়তার ভর্তুকি তার প্রয়োজন।

৩. পাঠককে খেতে দেয়া, বা না-খেতে দেয়া...

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটা আলোচ্য বিষয় সর্বদাই, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে রাষ্ট্র কিভাবে দেখবে। এই ঝামেলার কারণ একদিকে গবেষণা, স্বাধীন অনুসন্ধান এবং মুক্তচিন্তা ছাড়া নেতৃত্ব ধরে রাখা যায় না। এটা কিন্তু কেবল যুদ্ধাস্ত্রের প্রযুক্তির নেতৃত্ব না, অথবা পণ্য উদ্ভাবনের নেতৃত্বও না। সারাদুনিয়া জুড়ে মতাদর্শিক নেতৃত্বও ধরে রাখতে হলে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয় সামাজিক ও মানবিক নানান বিদ্যায়। এর অন্যদিকটাতে, স্বাধীন গবেষণা বা চিন্তা চর্চা প্রায়ই মুনাফা যতটুকু অনুমোদন করে তার চাইতে বেশি কিছু দাবি করে বসে, তার চাইতে বেশি সম্ভাবনা সে দেখতে পায় বলে। এই কারণেই দেশটির প্রধান দুটো দলেরই রক্ষণশীল অংশ বরাবরই বুদ্ধিজীবীদের ওপর খ্যাপা। নগদ টাকা আয় করে না, এমন বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বিষয়ে তাই সুযোগ পেলেই খড়গ নেমে আসে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তা ছড়ায় কিংবা শক্তি জোগায় সমাজের আর সব ক্ষেত্রগুলোতে: পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন, কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে তার রসদ জোগানোটা কট্টরপন্থীদের পছন্দ নয় কোন কালেই। সুযোগ পেলেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ভর্তুকি কমান, আরও বহু সামাজিক ও কল্যাণমূলক খাতগুলোর মতই।

সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী-বিরূপ সংস্কৃতি আসলে এইটা। যা চিহ্নিত করে সমাজের গণতন্ত্রায়ন, কল্যাণমূলক সমাজ গড়ার সম্ভাবনা বা সমতার বাস্তবতা বিষয়ক গবেষণাগুলোকে বিদেশী চিন্তা (যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় তা সমাজতন্ত্রী, ইউরোপীয় বা মার্কিন জীবনপ্রণালী বিরোধী চিন্তা) হিসেবে দেখানো এবং তাকে দমন করা, বিরোধিতা করা। বুদ্ধিজীবী সর্বদা সঠিক হবেন তার চিন্তায়, এমন কোন কারণ নেই। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সেটাকে মোকাবেলা করাও সম্ভব। কিন্তু চিন্তাগুলোকে আদৌ বিবেচনায় না নিতে চাওয়া, এবং যা আছে, যা জনপ্রিয় এবং যা কায়েমী তাকেই চিরস্থায়ী বলে ধরে নেয়া; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা দমনের চেষ্টা এবং সাথে অনুষঙ্গ হিসেবে আসবে ছদ্মবুদ্ধিজীবীদের বিদ্রুপ ও গুরুতর আলোচনাকে উপেক্ষা।

এটার ধ্রুপদী উদাহরণ মিলবে ঊনিশ শতকের কোলকাতায়। বিধবা বিবাহ, সতীদাহ নিরোধ, নারীশিক্ষার মত সনাতনী সমাজের জন্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গগুলোতেই কেবল নয়, খাদ্য-পোষাক-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-সমাজ গঠনসহ প্রায় সকল প্রশ্নেই প্রতিটি প্রশ্নেই যে অগ্রগতিগুলো অনিবার্যভাবে সমাজে ঘটছিল, তার প্রতি অজস্র বিদ্রুপ-রসিকতার দেখা মিলবে সমকালের সাহিত্যে, ধরন হিসেবে সেগুলোকে বুদ্ধিবীজী-বিরূপ বলে সহজেই চেনা যায়। এই বিরূপতার লক্ষ্য কিন্তু উপনিবেশ বিরোধিতা না, বরং তাদের অধিকাংশ আরও নির্ভেজাল ইংরেজ-শাসন ভক্ত মানুষ। এই বিরূপতার কারণ একটা অস্বস্তি, চেনা যুক্তিবোধের বাইরে অন্য কিছু জনপ্রিয়তা লাভ করছে, বা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বুদ্ধিজীবী-বিরূপতার একটা প্রধান স্থায়ী বৈশিষ্ট্য তাই নতুন একটা কিছুর সম্ভাব্যতার বিরোধিতা। সেটা রাষ্ট্রের দিক থেকে আসতে পারে, আসতে পারে ক্ষমতাবানদের দিক থেকে।

এর একটা নির্দশন হাল আমলে মিলবে ভারতে ইতিহাসবিদদের ওপর কাঠামোগত ও সংঘবদ্ধ আক্রমণে। বিজেপির মাঝে উদার বলে পরিচিত অটলবিহারী বাজপায়ীর আমলে রোমিলা থাপারের মত ইতিহাসবিদের কাজের ওপর তীব্র আক্রমণ চালানো হয়। কারণ থাপারের ইতিহাস-ভাষ্য বিজেপির জন্য আরামদায়ক না। নরেন্দ্র মোদীর আমলে সেই আক্রমণই আরও ঘনীভূত হয়েছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাককার্থির আমলে যেমন সমাজন্ত্রীদের ওপর একটা বুদ্ধিবৃত্তিক দমন অভিযান চলেছিল, তারই সাথে তুলনীয় একটা কিছু আমরা বর্তমান ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখেছি নানান মাত্রায়, বুদ্ধিজীবীদের ওপর তো বটেই।

কাজটা কঠিন, কিন্তু সত্যি রক্ষণশীলরা খুব আনন্দ পেতেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধই করে দিতে পারলে। কেবল যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেইটুকু গবেষণার সুযোগ তারা তবে দিতেন।

৪. বাংলাদেশের মানুষ কি বুদ্ধিজীবী-বিরূপ?

এটা একটা জটিল প্রশ্ন। সাধারণভাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বিমুখ বলতে বোঝানো হয় বইপত্র পড়েটরে কি না, কিংবা কেনে কিনা। জ্ঞানার্জন বিষয়ে চরম অনাগ্রহী একজনকে বুদ্ধিজীবিতা-বিমুখ বলা যেতে পারে, কিন্তু এর মানে এই না তিনি বুদ্ধিজীবী-বিরূপ, নতুন চিন্তা বা জীবনাদর্শের প্রতি তার শত্রুতাবোধ নাই থাকতে পারে। যদিও বইপড়া বা কেনার সাথে বুদ্ধিজীবী-বিরুপতার একটা দূরবর্তী সম্পর্ক থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে।

সমাজে সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা থাকতে গেলে বুদ্ধিজীবিতার একটা চর্চা সবার আগে থাকতে হবে।

বরং আমরা ভাবতে পারি আমাদের সমাজে সেই চর্চাটা কতটুকু উপস্থিত? আমাদের সমাজে কারা বুদ্ধিজীবীরা আছেন? চিন্তার জগতে বা সমাজের চলনবলনে তাদের প্রভাব কতটুকু?

এটা একটা মর্মান্তিক ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা যে, ঊনিশ শতকে বাঙলায় চিন্তার জগতে যে গভীর আলোড়ন দেখা গিয়েছিল, তার সাথে তুলনীয় কিছুই আজ অবশিষ্ট নাই। তার বহু রকমের দুর্বলতা ছিল, এমনকি সাম্প্রদায়িক গড়নের দিক দিয়েও তা গঠিত ছিল প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্তের দ্বারা। কিন্তু এতকিছুর পরও, বিখ্যাত 'বাংলার কাব্য' গ্রন্থে হুমায়ূন কবীর যেটা দেখিয়েছিলেন, এত অল্প সময়ের ব্যপ্তিতে এত বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনের নজির খুব কম জাতির আছে।

বাকি ভারতবর্ষের চোখে, এবং বিদেশীরাও বহুক্ষেত্রে বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন। রীতিমত মন খারাপ করে পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ ১৯৩৩ সালে লিখেছিলেন যে, টমাস পেইনের 'যুক্তির যুগ' বইটির এক হাজার কপি কলকাতার বাজারে ছাড়েন এক ব্যবসায়ী, দুই শিলিং দরে সেগুলো বিক্রি হয়েছিল নিমিষেই। এমনকি বিলম্বে সংবাদ পাওয়ারা ৮ শিলিং দাম হেঁকেও তা আর পাননি।

বাঙালীর চিন্তার অগ্রগামিতার প্রশংসায় গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ঊনিশ শতকের শুরুতে যেমন বলেছিলেন 'বাঙালীরা আজ যা ভাবে, ভারত তা কাল ভাবে।'

শুধু গোখলে নয়, বিশ শতকের একটা বড় অংশ জুড়ে বাঙালীর বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি ভারতবর্ষ জুড়ে একটা সমীহ ছিল। বহু লেখকের সাক্ষ্যে তার নিদর্শন মিলবে, খুব পরিহাসতরল ভাষায় পাঞ্জাবে এক পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষ্যে সেটার একটা বর্ণনা সৈয়দ মুজতবা আলী তার 'দেশে-বিদেশে' গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। পশ্চিম বাঙলায় যে বিদ্ব্যসমাজ গড়ে উঠেছিল, শুধু সাহিত্য আর সমাজবিজ্ঞানে আগ্রহ নয়, গণিত, পদার্থ ও রসায়নেও তারা যে মৌলিক ভূমিকা রেখে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন, মৌলিক ভূমিকা রেখেছিলেন এক ঝাঁক বিজ্ঞানী।

এই অতীত বুদ্ধিজীবিতার মোহ যে পশ্চিবঙ্গকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সে বিষয়ে সমকালীন একজন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: বাঙালীরা ভাবতো তারা সামনের কাতারে আছে। এই ভাবনা তাদের কখনো ছেড়ে যায়নি, এমনকি ভারতের অন্য অংশগুলো তাদের ছাড়িয়ে যাবার পরও। আর এই আচ্ছন্নতাকে বিদ্রুপ করে দেখেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা আবীর ভট্টাচার্যের চলচ্চিত্র বিষয়ক আলাপে, অনুবাদে খানিকটা তা এমন হবে: বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিবাদের প্রতি বাংলার সর্বদাই একটা ঝোঁক আছে, এবং মনে হয় এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঝোঁক ধীর গতিতে এক ধরনের ছদ্ম-বুদ্ধিবৃত্তিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে যেটা বাংলা চলচ্চিত্রেই কেবল দেখা যাবে।

বলা যায়, ভারতে একটা চালু কৌতুক এমন যে, বাংলা জগতের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন অর্থনীতিবিদের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু বাংলা অর্থনৈতিক ভাবে দরিদ্র। অন্যদিকে গুজরাটে কোনো কৃতী অর্থনীতিবিদ নেই, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তা অগ্রসর। এই কৌতুকের মাঝে অর্থনীতির যে সত্যতাটি আছে, সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সামর্থ্য ও চাহিদার ওপর তার প্রভাবটি অনিবার্য। এর ক্ষয়ের কারণ এর বিকাশের ধরনের মাঝেই নিহিত ছিল, ঊনিশ শতকের জমিদারী ব্যবস্থার ধীর পতন ও আয় হ্রাস, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে মুসলিম মধ্যবিত্তের আবির্ভাব এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জলাবদ্ধতায় এই বিকাশের কোন গতিশীল ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অর্থনীতিতে ভারতে নেতৃত্বের পর্যায়ে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কমতির দিকে হলেও বই পড়ার সংস্কৃতি ভারতের মাঝে উল্লেখযোগ্য। এখনও।

ভাষা ও রাজনীতির জটিল এক যৌথ ইতিহাসের কারণেই পশ্চিমঙ্গের আলোচনা ছাড়া পূর্ববঙ্গের বিষয়টি তোলা মুশকিল। হুমায়ুন কবীরের 'বাংলার কাব্য' অনুসরণ করেই বলা যায়, বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পরিবেশটি পেয়েছিল, সেটির অভাবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সাম্প্রদায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে অতিরিক্ত ঝোঁক বশত: 'আবির্ভাবের মূহুর্তেই একান্তভাবে নেতি ধর্মী' হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেসব সত্ত্বেও ১৯৪৭ এর পর ১৯৫০ দশকে প্রবণতা আকারে এবং ১৯৬০ এর দশকে দর্শনীয়রূপে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজের আবির্ভাব। সম্ভবত ৬০ দশকেই পূর্ববাংলা তার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের তৈরি করেছিল, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও আইনের চিন্তায় তার ধারাবাহিকতা ও প্রভাব এখনও অনুভব করা যায়।

মর্গানের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়েই, ষাট দশকের মফস্বল-প্রায় ঢাকা শহরে কিন্তু প্রাণবন্ত একটা গ্রন্থসংস্কৃতি গড়ে উঠবার সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাই। সমাজবিজ্ঞান কিংবা ভৌত বিজ্ঞানে আগ্রহী তরুণ গবেষকদের দেখা মিলতে শুরু করে, এর ছাপ পড়ে এমনকি রাজনীতিতেও।

এখানে বলা প্রয়োজন, বিশ শতকের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণের সাথে শিক্ষার দাবি ও আধুনিকতার দাবি জড়িত ছিল, সেই অর্থে বলা যায় সাধারণভাবে শিক্ষা বঞ্চিত হলেও পূর্ববাংলার মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করতেন। বঙ্গভঙ্গের রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক শিক্ষা ও চাকরির সমতার দাবিগুলোকে সামনে এনে হিন্দু মধ্যবিত্তের বিরক্তির শিকার হয়েছিলেন, বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দলনে না অংশ নেয়ার ন্যায্যতা হিসেবে মুসলমান মধ্যবিত্তের কারও কারও পক্ষ থেকে এমন যুক্তি এসেছিল যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গেলে মুসলমান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তারা পিছিয়ে আছেন। শিক্ষিত লোকের প্রতি ঔসুক্য এবং শ্রদ্ধাবোধ, ছাত্রদের প্রতি মর্যাদা এই দেশের ঐতিহ্যের মাঝে সাধারণভাবে ছিল।

১৯৭১ এ পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের দেশীয় দোসরদের তালিকা করে বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনায় বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তাকেই অনেকে দায়ী করেন পূর্ববাংলায় বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রায় কোন প্রভাব না থাকার জন্য। আমি এর সাথে একমত নই। ১৯৭১ এর চাইতে অনেক গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরে শিক্ষিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের দেশত্যাগে। কিভাবে তাহলে ৫০ এবং ৬০ দশকের এই বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব সম্ভব হলো? কারণ সেই শূন্যতা পূরণ হয়েছিল সমাজের বাস্তব চাহিদার মেটাতেই। ১৯৭১ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ড জনিত ঘাটতিও পূরণ সম্ভব হতো, যদি নবীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর তেমন কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা থাকতো। বরং দৃশ্যতঃ মনে হয় ৫০ ও ৬০ দশকের বুদ্ধিজীবীদের জেরটাই কোন ক্রমে অব্যাহত থেকে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছে। ৭০ ও ৮০ দশকের অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদরা যারা আছেন, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন এক একজন ব্যক্তি বলেই মনে হয়। অথচ তাদের ধারাবাহিকতাতেই উচ্চতর চাহিদা ও চাপ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সম্ভাবনা ছিল প্রবল একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের। মিথ্যা ইতিহাসে নিজেদের আর না ভুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত কোন কর্মসূচির অভাবে, অর্থনীতিতে কোন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির ফাঁদে পড়ে, রাজনীতিতে কোন স্বৈরতান্ত্রিক মনোবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়ে, পররাষ্ট্রনীতিতে কিভাবে আনুগত্য করে আমরা একটা বিকাশমান জাতিসত্তার অগ্রগতি রুদ্ধ করে দিতে সক্ষম হলাম, প্রাণচঞ্চল একটা বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠীকে বুদ্ধিজীবী-বিরুপ করে গড়ে তুললাম, তার অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে।

৫. পাঠাগারকে যা গেলানো হচ্ছে...

বুদ্ধিজীবি-বিরূপতার সাথে সমাজে গবেষণা ও পাঠাভ্যাসের সংস্কৃতির একটা গুরুতর সম্পর্ক কিন্তু আছে। আবার, পঠনের সংস্কৃতিরও বিকাশটা সম্ভব হয় প্রধানত রাষ্ট্রে উৎপাদনশীলতার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে। মর্গানের নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশকে সেখানকার হার্ভার্ডে অর্থনীতি পড়তে যাওয়া নিয়ে লোকের আপত্তি শুনতে হয়ছে বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামকে, সে কথা তিনি লিখেছেন তার Making of a Nation, Bangladesh: An Economist's Tale বইটিতে। সকলেই তাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার জন্য। কয়েক দশকের মাঝেই হার্ভার্ড পৃথিবীর আকর্ষণীয়তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটাতে পরিণত হয়। ষাট এমনকি সত্তুরের দশকেও আমাদের চাই্তে বহুগুন পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়াতে একটা ছোট্ট কিন্তু স্পন্দনশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ গড়ে উঠলেও রাষ্ট্রটির তুলনামূলক কঠোর মনোবৃত্তি এদিক দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে এখনও। কিন্তু সেখানে উৎপাদনশীলতা আর গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকলে এরও সম্ভাবনার একটা যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা দেখবো।

বাংলাদেশে এককথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেন, তার একটা কারণ ফলাও করে বলা হয়। সেটা এই যে, এমনকি কেন্দ্রীয় পাঠাগারটিও পরিণত হয়েছে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মুখস্ত করার কেন্দ্রে। কিন্তু একটা সমাজে জ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাড়ছে কি না, তা আসলে প্রধানত নির্ধারিত হয় পূর্বসূরীরা কতখানি জ্ঞানের চাহিদা সমাজে তৈরি করতে পারছেন তার ওপর। অন্য কারণটি বলা হয় না, পত্রিকাও ছাপবে না। বরং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের নামের একটা তালিকা করে দেশের প্রধান পাঠাগারগুলোতে গিয়ে মিলিয়ে নিন, সেখানে কী কী আছে, কী কী নেই। আসলে, বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলো বইশূন্য, কোন গবেষকের বা সাধারণ পাঠকের ঔসুক্য মেটাতে তারা সক্ষম না। ষাট দশকের ধারাবাহিকতায় যে ন্যূনতম পাঠাগার সংস্কৃতি ছিল, সেখান থেকেও লেখকরা প্রায় বিতাড়িত কিংবা আমলাদের দয়ার পাত্রে পরিণত হয়েছেন।

মুজিব শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মুজিবকর্নারের নামে শত কোটি টাকার বেশি খরচ করে যে বইগুলো কেনা হয়েছে, সেখানে একটি মাত্র বই আছে যাকে গ্রন্থ বলা যায়, সেটা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আ্ত্মজীবনী। বাকি যে লেখকদের এবং প্রকাশকদের কোটি কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, তারা যে আদৌ লেখক, সেই বিষয়ে কেউ পূর্বজ্ঞাত নন, তাদের নিজেদেরও সম্ভবত এ নিয়ে দ্বিধার ঘাটতি নেই।

সমাজের সর্বত্র যেমন, ঠিক তেমনি এক সর্বগ্রাসী দুর্নীতিগ্রস্ততা এবং এমনকি বিদ্যাজগতের ওপর আমলাতান্ত্রিকতার প্রভাব বাংলাদেশের দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে আসা বুদ্ধিজীবী সমাজকে পাঠাগার থেকেও বিদায় করে দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে এবার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকান, তাকান নতুন পাঠ্যসুচির দিকে, সর্বত্র জনগণকে গুরুতর ও প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে অক্ষম, অজ্ঞ ও দূরবর্তী করে রাখার বাসনাই কেবল দেখতে পাবেন।

৬. কেন বুদ্ধিজীবীর সাথে মানুষের দূরত্ব?

বুদ্ধিজীবীর সাথে গণমানুষের দূরত্বের কারণে লোকরঞ্জনবাদী মনোবৃত্তি বাড়ছে দুনিয়া জুড়েই, এমন অভিমত পুরোপুরো অন্তঃসার শূন্য নয়। এটা ব্রেক্সিটের বেলায় সত্য ছিল, এটা ট্রাম্পের উত্থানের জন্যও দায়ী। এটা খুবই ঠিক যে, বুদ্ধিজীবী বহু তিক্ত বাস্তবতা জনগণের সামনে তুলে ধরেন, যা হজম করাটা সর্বসাধারণের পক্ষে সর্বদা কঠিন। তারপরও ঐতিহ্য হলো মানুষ পণ্ডিতদের, বুদ্ধিজীবীদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। কিন্তু যে কারণেই হোক, কেন সাধারণ ইংরেজ ব্রেক্সিট চায়, বুদ্ধিজীবী যদি তার যথাযথ কারণ সন্ধান না করে তার কূপমণ্ডুকতাকেই কেবল দায়ি করতে থাকেন, দূরত্ব হবেই। দরিদ্র মার্কিন কেন ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছে, তার সত্যিকারের উপশম অর্থনীতি-রাজনীতিতে কী হতে পারে, সেটা বুদ্ধিজীবী নির্দেশ করতে ব্যর্থ হলে বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হবেই।

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর প্রতি জনগণের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সম্ভবত অনেক গভীর ছিল বহু অস্বস্তি সত্ত্বেও, কিন্তু নতুন বাস্তবতায় দূরত্বটা সম্ভবত বাড়ছে উত্তোরোত্তর বেশি হারে। বাংলাদেশের ৫০ ও ৬০ দশকের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ বামপন্থী কিংবা জাতীয়তাবাদী। জাতীয়তাবাদী অংশটি স্বাধীনতার পর থেকে সম্ভবত জনগণ থেকে দূরে সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত গণ্ডীতে আটকা পড়তে থাকেন কোলকাতা কেন্দ্রিক মনোবৃত্তির জন্য। বামপন্থী অংশটি বলতে গেলে শুকিয়ে কাঠ, এবং প্রায় বিলীয়মান।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানে অর্জিত সাধারণার ঠিক বিপরীতটি পোষণ করেন বলে গণমানুষ তাদেরকে তাদের স্বার্থকে ভাষা দিচ্ছেন বলে মনে করেন না। যেমন ১৯৪৭ এর দেশভাগ প্রশ্নে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী বয়ান ইতিহাসলিখন, নাটক, উপন্যাসে পূর্ববাংলার মুসলমানদের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছেন। হালে জয়া চ্যাটার্জির 'বাংলা ভাগ হলো'র মতো অসাধারণ গবেষণাকর্মে ৪৭ এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পশ্চিমবঙ্গে মিলেছে, কিন্তু পূর্ববাংলায় বদরুদ্দীন উমরেরা সংখ্যালঘু হয়ে থেকেছেন একই ব্যাখ্যা আরও আগে হাজির করে। একই বিষয় পাওয়া যাবে সাধারণ মানুষের ধর্ম-জীবনাচার-সংস্কৃতির প্রতি সাধারণ বুদ্ধিজীবীসুলভ অশ্রদ্ধায়। হাতে গোণা যাবে বাংলাদেশের কতজন বুদ্ধিজীবী ফারাক্কার মত প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সুন্দরবন রক্ষার মত আন্দোলনে কিংবা দেশের কৃষি-শিল্প রক্ষার বিষয়গুলোতে মানুষ বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা খেয়াল করেনি এমন নয়। খুব খেয়াল করে তারা এমনকি এটাও দেখেছে ভাড়াটে গবেষণা ছাড়া চাষী কিংবা মজুরের, দেশবাসীর স্বার্থ নিয়ে স্বার্থহীন প্রচুর কাজের নমুনা বুদ্ধিজীবীদের দিক থেকে নেই।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীর প্রতি সমাজে যদি কোন সাধারণ বিরূপতা থেকে থাকে, সেটা বুদ্ধিজীবীরা অর্জন করেছেন তাদের মোসাহেবী, তাদের নীরবতা এবং তাদের বিচ্ছিন্নতা দিয়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু। সেতুটি একদিনে জোড়া লাগবার নয়। 'সাত সামুরাই'কে নিয়ে কুরোশাওয়ার অনন্য চলচ্চিত্রটার একটা মূহুর্ত এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, যেখানে সামুরাইয়ের সাজ-পোষাক পড়া চাষার ছেলেটা রেগে গিয়ে খাঁটি সামুরাইকে বলছে: এত সহজে আশা করো কৃষক তোমাদের ভালোবাসবে? রাজা আর জমিদারের হয়ে কৃষকের ধান লুট করেছো, তাদের মেয়েদের ওপর নির্যাতন করেছো, চাষাকে বাধ্য করেছো নতজানু হয়ে থাকতে, আর আজকে আশা করছো একদিনেই চাষা তোমাকে বিশ্বাস করবে!

নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীদের এই সব কিছু নিয়েই ভাবতে হবে। একটু খেয়াল করলেই আসলে দেখা যাবে, সংখ্যাল্প কয়েকজন বাদ দিয়ে প্রাচীন ও জেষ্ঠতররা অস্তগামী, এবং প্রায় সর্বাংশে প্রভাবহীন।

কিন্তু এর মানে কিছুতেই এই নয় যে বুদ্ধিজীবী সময়ের চাহিদার কাছে, বা মানুষের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের কাছে নিছক আত্মসমর্পণ করবেন। বুদ্ধিজীবী এমনকি সময়কে, জনগণকে চাবুকও মারবেন তাদের অসহিষ্ণুতা, তাদের ঘৃনা চর্চা, তাদের মতান্ধতা জাতিদম্ভী আচরণের জন্য। কিন্তু এমন বুদ্ধিজীবী তো দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতাকে মেনেই নিয়েছেন। আজকে আমরা এমন একটা সময়ে বুদ্ধিজীবীর সাথে গণমানুষের দূরত্ব নিয়ে কথা বলছি, যখন এই আর্ত, অপমানিত, ক্লান্ত মানুষগুলো খানিকটা শুশ্রুষাও চায়।

শুশ্রুষাও বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য, বিশেষ করে এমন সময়ে।


Published/Broadcast by: The Business Standard
Date Published: 25 November, 2020, 02:50 pm
Last modified 26 November, 2020, 01:23 pm
Author: ফিরোজ আহমেদ
Entry Type: Opinion piece

Source: https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A4/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%82%E0%A6%AA?fbclid=IwAR1oPocei4JtoSqC305SCNV5U93H_fNcRBCN6jlbwbMiu6Nfv8cgbdxJFbU#.X74qeldUzaY.facebook