মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষা- একটি আরেকটির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত এই তিনের কোনো একটিকে যেমন আরেকটি থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালি আর বাংলাদেশও একই সুতায় গাঁথা। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করে ইতিহাস
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছিন্ন সত্তার নাম। তারা বলছেন, বাঙালি জাতির এই মহানায়কের জন্ম না হলে এই স্বাধীন ভূখ-ের জন্মই হতো না।
বঙ্গবন্ধু সারা জীবন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর অন্তরে সব সময়ই কাজ করত বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশ। বাঙালি জাতিকে স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালি। আর এই কাজে তিনি বাঙালিকে নিয়ে সফলও হয়েছেন। আজ বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে যখন লাল-সবুজের পতাকা পত পত করে ওড়ে তখন সেই পতাকায় ফুটে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছিষট্টির ৬ দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব ক্যারিশমা আর নেতৃত্ব দেখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন সবার মধ্যমণি। স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণের পথটিও দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আজও আমরা তাঁর দেখানো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। এই অগ্রযাত্রার সৈনিক প্রতিটি বাঙালি।
পারিবারিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের কারণে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর তীব্র আগ্রহ ছিল এ কথা সবার জানা। তবে এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ভেতর একটা শিল্পীমন এবং শৈল্পিক চিন্তাধারা ও মননের দিক ছিল সেটা পরবর্তীতে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনায় এক ধরনের সৃষ্টিশীল বিষয় কাজ করত। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে আমরা সেসবের উপস্থিতি টের পাই। তাঁর পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ, পরিবেশ, বাবা-মার প্রখর ব্যক্তিত্ব, বর্ণিল শৈশব, প্রকৃতির সীমাহীন সৌন্দর্য সর্বোপরি পড়াশোনার প্রতি অনুরাগÑ এসব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি করে। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে সে কথা লিখেছেনওÑ ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটবেলা থেকেই আমি সব কাগজই পড়তাম (পৃষ্ঠা ১০)।’
টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারের সন্তান হয়ে কখনোই বঙ্গবন্ধু নিজেকে জাহির করতেন না। দশজনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে চলতে-ফিরতেই বেশি পছন্দ করতেন। বাঙালির ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। বাংলার নদী, বাংলার জল, বাংলার সাধারণ মানুষ আর বাংলার উদার প্রকৃতিও প্রবলভাবে টেনেছিল তাঁকে।
প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক আদ্রে মার্লো ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলোÑ ‘তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) আর শুধুমাত্র একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পাওয়া যায় না। তাঁকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি, শস্যক্ষেত্রের মাঝে।’
দুই.
বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে অন্তরে লালন করতেন তিনি। গানবাজনা, নাটক, গল্প-উপন্যাস, কবিতা তাঁকে দেখিয়েছিল নতুন পথ। তিনি নিজেও প্রচুর বই পড়তেন, অবসর কিংবা কারাগারে তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল বই পড়া, গান শোনা। গানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা একধরনের আলাদা ভালোবাসা ছিল যার প্রমাণ আমরা তাঁর লেখায় বারবার পাই। বাংলা গানের অসম্ভব রকমের ভক্ত ছিলেন তিনি। তিনি নিজেও গুনগুন করে গান গাইতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১১১ পৃষ্ঠায় আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি গান শুনে একজন কবির মতোই লিখছেন, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতে ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তার গান শুনছে।’
কি আশ্চর্য!
নদীর ঢেউও আব্বাসউদ্দিনের গান শুনছে!এই কথা শুধু রাজনীতির কবি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই উচ্চারণ করা সম্ভব।
তিন.
কিভাবে, কবে থেকে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি আমাদের চেতনার সঙ্গে, হৃদয়ের অলিন্দে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে, অস্থিমজ্জায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল? রবীন্দ্রনাথের এই গানটি কিভাবে আমাদের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেল তা নিয়ে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা তাদের মতামত ও বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মনের কথা, আবেগের কথা, ভালোবাসার কথার অনুভব পেতেন। বাঙালিকে কবিগুরু অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের ৩ দিন ব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে। গানটির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর আলাদা আবেগ। এই গানটিকেই যে তিনি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করবেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গবেষকরা আরও বলছেন, বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর গানে মানুষের দেশপ্রেম, আবেগ, ভালোবাসা, মুক্তির ডাক, অত্যাচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সবই খুঁজে পেয়েছিলেন সার্থকভাবে।
সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি অসম্ভব রকমের গান পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। শিল্প সাহিত্যের প্রতি আলাদা ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছিল তাঁর। তাঁর দীর্ঘ কারাবাসের সময়ও তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বাংলা সাহিত্যের নামকরা লেখকদের বই তো পড়তেনই, এর বাইরে বিদেশি সাহিত্যের প্রতিও তাঁর দুর্বার আকর্ষণ ছিল। তিনি বন্দি অন্য নেতাদেরও বই পড়া, গান শোনাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিলেন কবিগুরুর লেখা। বঙ্গবন্ধুর ওপর যারা গবেষণা করছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন তা। তারা এ প্রসঙ্গে বলছেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর বাণী আর গান শুনে তাঁর নিজস্ব স্বপ্ন পূরণে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়েছেন। কবিগুরুর গান তাঁকে উৎসাহ আর প্রেরণা জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে, দুঃসময়ে কিংবা উত্তাল সময়ে বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ণয়ের কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে রবীন্দ্রনাথ তার গান দিয়ে, বানী দিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পরম বন্ধুর মতো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ভেতরে বাঙালি জাতিসত্তার ভাবনার বীজ সফলভাবে প্রোথিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র গবেষকরা বলছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলা ও বাঙালিকে স্বাধীন করার যাবতীয় অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তি বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। কবিগুরুর লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু যেভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান আর তার লেখা পড়েও তিনি সমানভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেনÑ এ কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা, লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও গবেষক অধ্যাপক সনজীদা খাতুন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আমার সোনার বাংলা’ শীর্ষক এক লেখায় রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। তিনি তার লেখায় ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকদের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখছেন, ‘পঞ্চাশ দশকে একবার আমার খুব ভালো করে মনে আছেÑ কার্জন হলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কি গান গাইব? এমন সময় দেখা গেল সেখানে বঙ্গবন্ধু। তখন তো তাঁকে কেউ বঙ্গবন্ধু বলে নাÑ শেখ মুজিবুর রহমান বলে। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘সোনার বাংলা’ গানটা গাইÑ‘আমার সোনার বাংলা।’ আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এত লম্বা একটা গান। তখন তো আর এটা জাতীয় সংগীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাব? আমি তখন চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে সে গান গেয়েছিলাম কোনোমতে। জানি না কতটা শুদ্ধ গেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এভাবে গান শুনতে চাওয়ার একটা কারণ ছিল। তিনি যে অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানে পাকিস্তানিরাও ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই গানটার ভেতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং আমার তো মনে হয় তখনই তাঁর মনে বোধহয় এটাকে জাতীয় সংগীত করার কথা মনে এসেছিল। বায়ান্ন সালে আমরা যখন রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করি তখন কিন্তু ওই বায়ান্নর পর পর শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরিতে আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম এবং এভাবে রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু তখন বেশ চলেছে। আরো পরে কেমন করে যেন একটা অলিখিত বাধা এলো। পাকিস্তান আমলের পরে রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যখন জাতীয় সংগীত হলো, তার কিছুকাল পরে দেখা গেলÑ নানা ধরনের অনুষ্ঠান চলছিল তো সেই সময় গানটা না করে শুধু বাজনা বাজাবার একটা রেয়াজ শুরু হলো। আমার মনে হয় এর মধ্যে সেই পাকিস্তানি মনোভাবটা কাজ করেছে।’
ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই গানটি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। তবে এই গানটি আরও আগে থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালিকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সে সময়ের সভা-সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হতো। গবেষক, ভাষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই গান নিয়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি প্রতিটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণাও জুগিয়েছে।
অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার সোনার বাংলা গানটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি গাইতে বলতেন। তিনি নিজেও অনেক সময় গুনগুন করে গানটি গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে।
‘আমার সোনার বাংলা কেমন করে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলো সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর তখন ‘স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে গ্রহণ করে নিই।”
চার. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে বসে। বঙ্গভঙ্গের সময়, ১৯০৫ সালে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। গানটির মূল পা-ুলিপি না পাওয়ায় গবেষকরা এই গানের সঠিক রচনার তারিখ খুঁজে বের করতে পারেননি। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্ত কুমার পালের মতে, এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলের এক অনুষ্ঠানে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে ( ১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র ) কবির স্বাক্ষরসহ সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার গানটি ছাপা হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। জমিদারি দেখভালের কাজে ১৮৮৯-১৯০১ পর্যন্ত অনেকবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা, নওগাঁ এলাকায় আসা-যাওয়া করেছেন, থেকেছেন। তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান, বাউল গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় লেখা অনেক গানে তিনি পূর্ব বাংলার লোকগানের সুর ব্যবহার করেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই কুষ্টিয়ার লোককবি ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের সঙ্গে মিল রেখে সুর করেছেন এ কথা তিনি বলেছেনও।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথ এই গান বাংলা, বাংলাদেশ আর বাঙালিকে সামনে রেখে লিখেছিলেন এ কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের আনাচে-কানাচে যেখানেই এই গানের সুর বেজে উঠবে তখনই সেখানে ফুটে উঠবে এক সিংহ হৃদয়ের মানুষের ছবি। বঙ্গবন্ধুর ছবি।
মাহবুব রেজা: কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের ৩ দিন ব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে। গানটির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর আলাদা আবেগ। এই গানটিকেই যে তিনি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করবেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গবেষকরা আরও বলছেন, বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর গানে মানুষের দেশপ্রেম, আবেগ, ভালোবাসা, মুক্তির ডাক, অত্যাচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সবই খুঁজে পেয়েছিলেন সার্থকভাবে।
সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি অসম্ভব রকমের গান পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। শিল্প সাহিত্যের প্রতি আলাদা ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছিল তাঁর। তাঁর দীর্ঘ কারাবাসের সময়ও তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বাংলা সাহিত্যের নামকরা লেখকদের বই তো পড়তেনই, এর বাইরে বিদেশি সাহিত্যের প্রতিও তাঁর দুর্বার আকর্ষণ ছিল। তিনি বন্দি অন্য নেতাদেরও বই পড়া, গান শোনাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিলেন কবিগুরুর লেখা। বঙ্গবন্ধুর ওপর যারা গবেষণা করছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন তা। তারা এ প্রসঙ্গে বলছেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর বাণী আর গান শুনে তাঁর নিজস্ব স্বপ্ন পূরণে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়েছেন। কবিগুরুর গান তাঁকে উৎসাহ আর প্রেরণা জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে, দুঃসময়ে কিংবা উত্তাল সময়ে বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ণয়ের কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে রবীন্দ্রনাথ তার গান দিয়ে, বানী দিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পরম বন্ধুর মতো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ভেতরে বাঙালি জাতিসত্তার ভাবনার বীজ সফলভাবে প্রোথিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র গবেষকরা বলছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলা ও বাঙালিকে স্বাধীন করার যাবতীয় অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তি বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। কবিগুরুর লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু যেভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান আর তার লেখা পড়েও তিনি সমানভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেনÑ এ কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা, লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও গবেষক অধ্যাপক সনজীদা খাতুন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আমার সোনার বাংলা’ শীর্ষক এক লেখায় রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। তিনি তার লেখায় ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকদের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখছেন, ‘পঞ্চাশ দশকে একবার আমার খুব ভালো করে মনে আছেÑ কার্জন হলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কি গান গাইব? এমন সময় দেখা গেল সেখানে বঙ্গবন্ধু। তখন তো তাঁকে কেউ বঙ্গবন্ধু বলে নাÑ শেখ মুজিবুর রহমান বলে। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘সোনার বাংলা’ গানটা গাইÑ‘আমার সোনার বাংলা।’ আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এত লম্বা একটা গান। তখন তো আর এটা জাতীয় সংগীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাব? আমি তখন চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে সে গান গেয়েছিলাম কোনোমতে। জানি না কতটা শুদ্ধ গেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এভাবে গান শুনতে চাওয়ার একটা কারণ ছিল। তিনি যে অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানে পাকিস্তানিরাও ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই গানটার ভেতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং আমার তো মনে হয় তখনই তাঁর মনে বোধহয় এটাকে জাতীয় সংগীত করার কথা মনে এসেছিল। বায়ান্ন সালে আমরা যখন রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করি তখন কিন্তু ওই বায়ান্নর পর পর শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরিতে আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম এবং এভাবে রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু তখন বেশ চলেছে। আরো পরে কেমন করে যেন একটা অলিখিত বাধা এলো। পাকিস্তান আমলের পরে রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যখন জাতীয় সংগীত হলো, তার কিছুকাল পরে দেখা গেলÑ নানা ধরনের অনুষ্ঠান চলছিল তো সেই সময় গানটা না করে শুধু বাজনা বাজাবার একটা রেয়াজ শুরু হলো। আমার মনে হয় এর মধ্যে সেই পাকিস্তানি মনোভাবটা কাজ করেছে।’
ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই গানটি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। তবে এই গানটি আরও আগে থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালিকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সে সময়ের সভা-সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হতো। গবেষক, ভাষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই গান নিয়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি প্রতিটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণাও জুগিয়েছে।
অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার সোনার বাংলা গানটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি গাইতে বলতেন। তিনি নিজেও অনেক সময় গুনগুন করে গানটি গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে।
‘আমার সোনার বাংলা কেমন করে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলো সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর তখন ‘স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে গ্রহণ করে নিই।”
চার. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে বসে। বঙ্গভঙ্গের সময়, ১৯০৫ সালে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। গানটির মূল পা-ুলিপি না পাওয়ায় গবেষকরা এই গানের সঠিক রচনার তারিখ খুঁজে বের করতে পারেননি। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্ত কুমার পালের মতে, এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলের এক অনুষ্ঠানে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে ( ১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র ) কবির স্বাক্ষরসহ সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার গানটি ছাপা হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। জমিদারি দেখভালের কাজে ১৮৮৯-১৯০১ পর্যন্ত অনেকবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা, নওগাঁ এলাকায় আসা-যাওয়া করেছেন, থেকেছেন। তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান, বাউল গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় লেখা অনেক গানে তিনি পূর্ব বাংলার লোকগানের সুর ব্যবহার করেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই কুষ্টিয়ার লোককবি ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের সঙ্গে মিল রেখে সুর করেছেন এ কথা তিনি বলেছেনও।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথ এই গান বাংলা, বাংলাদেশ আর বাঙালিকে সামনে রেখে লিখেছিলেন এ কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের আনাচে-কানাচে যেখানেই এই গানের সুর বেজে উঠবে তখনই সেখানে ফুটে উঠবে এক সিংহ হৃদয়ের মানুষের ছবি। বঙ্গবন্ধুর ছবি।
মাহবুব রেজা: কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
Published/Broadcast by: ঢাকা টাইমস
Date published: ১৫ আগস্ট, ২০১৭
Last modified: ১৫ আগস্ট, ২০১৭
Author: মাহবুব রেজা
Entry Type: Opinion Piece
Source: https://www.dhakatimes24.com/2017/08/15/44598/বঙ্গবন্ধু-বাঙালি-বাংলাদেশ-এক-সুতায়-গাঁথা?fbclid=IwAR3vy7slIWNu2dXW73QFizOj83sWXvf6VY56ISD14ToxB0RmxdWwpzab1O8