বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নয়; বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। হ্যাঁ, এই রাষ্ট্রের নাগরিকরা অধিকাংশই বাঙালি; কিন্তু এখানে অন্য জাতিসত্তার মানুষও রয়েছে। সেই সঙ্গে বাস্তব সত্য এটাও যে, বর্তমান পৃথিবীতে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর সম্ভব নয়। এখন এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতির বসবাসটা অনিবার্য। জাতিরাষ্ট্রের কথা যারা খুব উঁচু গলায় বলে, শেষ বিচারে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী, কিংবা ইসরায়েলিদের মতো ইহুদিবাদী বা ভারতের বিজেপির মতো ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাবাদী। হিটলারও জাতিরাষ্ট্রবাদীই ছিলেন।
বাঙালির দেশ তো শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গও বটে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ণবাদী ব্রাহ্মণরা পূর্ববঙ্গকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে ভেবেছিলেন, 'বাঙালি'কে রক্ষা করলেন। তাঁদের ভ্রান্তি এখন পরিস্কার হয়েছে হিন্দুত্ব দিয়ে বাঙালিত্বকে দাবিয়ে রাখার বিজেপি-তৎপরতার চাপে; পশ্চিমবঙ্গে এখন তাই 'জয় বাংলা' ধ্বনি আড়মোড়া ভাঙছে। ভারতীয় পরিচয়ের গৌরবগাথা সেখানকার বাঙালিদের জন্য কণ্টকশয্যা হতে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা।
স্মরণীয়, পূর্ববঙ্গকে আমরা যে বাংলাদেশ নাম দিয়েছি; পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কেউ কেউ তাতে আপত্তি করেছিলেন, বাঙালিত্বকে দ্বিতীয়বার হারাবেন ভেবে। ৪৭-এ হারিয়েছেন অখণ্ড ভারতের একটি খণ্ডিত প্রদেশে পরিণত হয়ে, একাত্তরে হারাবেন 'বাংলাদেশ'-এর কাছে। আমরা মোটেই বিস্মিত হবো না, যদি দেখি 'জয় বাংলা' আওয়াজটা শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদেরও রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। ভারত যে মোটেই একটি জাতিরাষ্ট্র নয়; বহু জাতিঅধ্যুষিত একটি রাষ্ট- এ বাস্তবতাকে ভারতীয় শাসকরা এতকাল ঢেকেটেকে রেখেছিলেন; আগামীতে মনে হয় আর পারবেন না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী এসইউসিআইও ভারতের বহু জাতিত্বের বিষয়কে এখন পর্যন্ত মান্য করে না; আগামীতে হয়তো না করে পারবে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত সিরাজুল আলম খানের আত্মজৈবনিক রচনা 'আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক জীবনাল্লেখ্য'তে উল্লেখ রয়েছে, জাসদ গঠনের পেছনে তাদের যে উপলব্ধি কাজ করেছে তার এক নম্বরটি ছিল এই রকমের :"যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলো, সেই 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' দলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে থাকতে হবে।" উপলব্ধির দুই নম্বরে সমাজতন্ত্র এসেছে; কিন্তু জাতীয়তাবাদকে পেছনে ফেলে নয়, মাথাতে রেখেই। বলা হয়েছে, 'জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার পাশাপাশি আমাদের সমাজতন্ত্রের অভিমুখে নিজেদের চালিত করতে হবে।' জাতীয়তাবাদই প্রধান, সমাজতন্ত্র হচ্ছে পরবর্তী বিবেচনা।
আবারও স্মরণ করতে হয়, জাতির ভেতর যে শ্রেণি আছে এবং শ্রেণি সমস্যাই যে সমাজের প্রধান সমস্যা; জাতীয়তাবাদীরা সেটা গ্রাহ্য করে না। করলেও করে বঞ্চিতদের বঞ্চনার ভেতরে রাখার লুক্কায়িত বাসনা থেকেই। নতুন দল গঠনের পেছনে কার্যকর পাঁচটি উপলব্ধির তিন নম্বরটি হলো, 'বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ নানা পার্থক্য ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।' অবশ্যই। সবাই তো সেটা বলবে। একবাক্যে। কিন্তু মূল 'পার্থক্য' যে কোনটি, সেটির কোনো উল্লেখ এখানে নেই। দলটি লড়বে সমাজতন্ত্রের জন্য। অথচ সে দল শ্রেণি চিনবে না, এতে চোখ ছানাবড়া করার দরকার পড়ে না, যদি স্মরণে থাকে যে এরা আসলে জাতীয়তাবাদীই। ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান আমলে ও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ যে রকম জাতীয়তাবাদী ছিল অর্থাৎ যেভাবে দীক্ষিত ছিল পুঁজিবাদে; আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা জাসদের মূল নেতৃত্বও অন্তর্গত চরিত্রে সে রকমেরই ছিল; যদিও তারা সমাজতন্ত্র ও সামাজিক বিপ্লবের আওয়াজ বেশ জোরেশোরেই তুলেছিল। তুলেছিল এই জন্য যে, তারা নতুন যুগের মানুষ এবং যে তরুণরা তাদের সঙ্গে ছিল, তারা ছিল তাদের তুলনাতেও অগ্রসর।
নতুন দল গঠনের পেছনকার উপলব্ধিগুলোর একটিতে ওই যুবকদের কথাটা পরিস্কারভাবে এসেছে। সিরাজুল আলম বলেছেন, 'সদ্য সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা যুবসমাজ স্বভাবতই হবে স্বাধীনচেতা। সেই যুবসমাজকে প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেই দলকে সংগঠিত করতে হবে।' যুবসমাজের এই শক্তিকে নাৎসি হিটলারও কিন্তু নিজের কাজে লাগিয়েছেন; যেমন কাজে লাগিয়েছেন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনিও। সমাজতন্ত্রের কথা এরাও বলতেন। কারণ রুশ বিপ্লবের পর ইউরোপে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতির। একাত্তরের যুদ্ধ দেখা ও যুদ্ধ করে ফেরত আসা তরুণদেরও জাসদ টানতে চেয়েছিল নিজের পক্ষপুটে। কিন্তু সেটা মুজিববাদের আওয়াজকে ব্যবহার করে আর সম্ভব হচ্ছিল না। তার প্রধান কারণ, তাত্ত্বিকভাবে মুজিববাদ কিম্ভূত এক গোঁজামিল ছাড়া অন্য কিছু নয়। যুদ্ধের সময়ে স্বতঃস্ম্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষাটা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের। তাজউদ্দীন আহমদরা ওই তিন নীতি দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। জাতীয়তাবাদের কথা তারা বলতেন না; বলার প্রয়োজন ছিল না। কারণ যুদ্ধের মূল ভিত্তিটাই ছিল পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প। যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল নতুন রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক করার পথে নিয়ে গিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সমাজে থেকে বিদ্যমান ব্যক্তিমালিকানাকে বিদায় করে সেখানে সামাজিক মালিকানা গড়ে তোলা। মুজিববাদের যারা উদ্ভাবক মূলত তারা হচ্ছেন বিএলএফের চার নেতা, পরে যাদের নাম দাঁড়িয়েছিল 'চার খলিফা'; যাদের প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, অন্য তিনজন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। এরা দাবি করতেন, শেখ মুজিব এদেরকে তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেছেন। তারা কিন্তু এটা বলতে ভুলে যেতেন যে, বঙ্গবন্ধু তাদেরকে এও বলেছিলেন- তারা যেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরামর্শ করে চলে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এরা সবাই গেছেন কলকাতায়। তাজউদ্দীন আহমদ গেছেন এদের সবার আগে এবং গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শক্রমে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে ফেলেছেন। এ কাজটি ছিল অত্যাবশ্যক। নইলে যুদ্ধ পরিচালিত হতো কার অধীনে? কার নির্দেশে? সেনাবাহিনীর যে বাঙালি অফিসাররা বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করেছেন, তাদের সামনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল- আনুগত্য জানাবেন কার প্রতি? খালেদ মোশাররফ তার যুদ্ধকালের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন 'মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স' নামের বইতে। তাতে তিনি বলছেন, ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তার আলোচনা হয় এবং তাদেরকে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার আনুগত্যের কথা জানান। কিন্তু মুশকিল তো ছিল এখানে যে, বাংলাদেশ সরকার নামে কোনো কিছুর অস্তিত্বই তখন ছিল না। ওদিকে ভারত সরকার যে সহায়তা দেবে, সেটা কাকে? আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সমর্থন ও সাহায্য চাইতে হবে; সাহায্যটা চাইবেন কে? সব বিবেচনাতেই সরকার গঠন ছিল তাই অপরিহার্য। বিএলএফের নেতারা কলকাতায় পৌঁছতে দেরি করে ফেলেছিলেন। সেখানে পৌঁছে যখন শোনেন সরকার ততক্ষণে গঠিত হয়ে গেছে, তখন তাজউদ্দীনের ওপর তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। শেখ সাহেবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির রাগটা ছিল অত্যুগ্র; তার দাবি ছিল- তাকে বাদ দিয়ে কোনো সরকার গঠন হতেই পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই তিনটি মূলনীতি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য যথেষ্ট। এর সঙ্গে; শুধু সঙ্গে নয় একেবারে সামনে, অনেকটা পাহারাদারের মতো জাতীয়তাবাদকে বসিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা কিন্তু প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নয়। সেটি যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারেরই। জাতীয়তাবাদী মূলনীতিকে সামনে নিয়ে আসাটা বিশেষভাবে দরকার পড়েছিল পুঁজিবাদী মতাদর্শকে অন্যান্য মূলনীতির ওপর পাহারাদারের অবস্থানে রাখার জন্যই। যেভাবেই হোক যুদ্ধে সমাজতন্ত্র ঢুকে পড়েছে; এখন তাকে দমানো চাই; দেখা চাই যাতে সে প্রবল হয়ে উঠতে না পারে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়া এবং একই সঙ্গে কমিউনিজমকে প্রতিহত করা। বিএলএফের বাইরের যে তরুণরা হাজারে হাজারে ভারতে চলে গিয়েছিল যুদ্ধ করবে বলে, তাদেরও মুক্তিবাহিনীতে নেওয়া হতো, যৎসামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হতো এবং অনেকেই আর ফিরে আসত না। কিন্তু গায়ে বামপন্থার সামান্যতম গন্ধ আছে, এমন তরুণদের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কমিউনিজম দমনের জন্য আয়োজনে কোনো ত্রুটি ঘটেনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলমকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি কমিউনিস্ট হতে রাজি নন, সেই জানানোটা ছিল অনাবশ্যক। কারণ সিরাজুল আলমদের ছাত্রলীগ কমিউনিস্ট তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এরাও মুজিববাদীই। বিএলএফকে মুজিববাহিনীতে রূপান্তরিতকরণ এঁরাই ঘটিয়েছেন।
স্লোগানের আকারে সে আওয়াজটা সেদিন সিরাজুল আলমই তুলেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে বঙ্গবন্ধুর এক জনসভাতে 'জয় বাংলা' স্লোগানও তিনি প্রথমে দেন এবং সেটিকে উদ্দীপক রেওয়াজে পরিণত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিববাদ দাঁড়াবে মার্কসবাদের প্রতিপক্ষ হয়ে- অঘোষিত সিদ্ধান্ত ছিল এটাই। আওয়াজটা বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও দেওয়া শুরু করেছিলেন। সিরাজুল আলম ছাত্রলীগে এসেছিলেন শাহ মোয়াজ্জেমের হাত ধরেই। শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির একটা দ্বন্দ্ব ছিল। দ্বন্দ্বের কারণ এই নয় যে, একজন বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদে, অপরজন সমাজতন্ত্রে। মতাদর্শের দিক থেকে উভয়েই ছিলেন পুঁজিবাদের সমর্থক। দ্বন্দ্বের কারণ ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ১৫ আগস্টের পর শাহ মোয়াজ্জেমের পক্ষে খন্দকার মোশতাকের দলে যোগ দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অন্যান্য মিল যেমন-তেমন; এই মিলটা তো ছিলই- দু'জনেই ছিলেন কমিউনিজমবিরোধী। খন্দকার মোশতাক তো বলতেনই যে, তিনি নন-কমিউনিস্ট নন, তিনি অ্যান্টি-কমিউনিস্ট।
লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক
Published/Broadcast by: সমকাল
Date published: ২৮ অক্টোবর ২০১৯
Last modified: ২৮ অক্টোবর ২০১৯
Author: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Entry Type: সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
Source: https://samakal.com/editorial-comments/article/19102460/ও-জাতিরাষ্ট্রের-ধারণা
Date published: ২৮ অক্টোবর ২০১৯
Last modified: ২৮ অক্টোবর ২০১৯
Author: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Entry Type: সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
Source: https://samakal.com/editorial-comments/article/19102460/ও-জাতিরাষ্ট্রের-ধারণা