Skip to main content

লালসালু’র সাংস্কৃতিক বিপর্যয়

❝অথচ ওয়ালীউল্লাহ মজিদকে বসালেন মাজারে, বঙ্গীয় ইসলাম চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। মজিদের চরিত্রের সঙ্গে মাজার কোনোভাবেই যায় না। মাজারের পরিবর্তে যদি মজিদকে একটা মসজিদে বা মক্তব্যে বসানো হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’তে যে সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তিটা ঘটিয়েছেন তার পুনর্পাঠ, পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ে দাবি❞

লালসালু সিনেমার দৃশ্য

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে ধর্মব্যবসাকে আক্রমণ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসলেন। এটি ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তি, কট্টরপন্থী আরবীয় ও সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সুক্ষ্ম ফারাকটাকে না বোঝার ফল।


প্রিয় পাঠক, শুরুতেই আমাকে মূর্খ আর বেয়াদব বলে গালি দেওয়ার আগে পুরো লেখাটা আগে পড়ুন, ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তিটা কোথায় তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। খুব গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে যে, মোদাচ্ছের পীরের কল্পিত মাজারের খাদেম হচ্ছে মজিদ। উপন্যাসে মজিদ যেসব উগ্র কথাবার্তা বলে, কট্টরপন্থী সালাফি অনুসারীদের মতো, বাংলাদেশের কোনো মাজারের কোনো খাদেম এমন উগ্র কথাবার্তা বলে না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এই দেশের মাজারগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে, মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেমদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে এমনকি ভারতের মাজারগুলোতে মজিদ-কথিত ওসব ইসলামি উগ্রবাদ অতীতে কখনো চর্চা হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না। যারা মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেম তারা উগ্রপন্থী নন, তারা সহজিয়া বঙ্গীয় মুসলমান। ঠিক এই কারণেই সিলেট শাহ্ জালালের মাজারে বোমা মেরেছিল জেএমবি। মাজারকেন্দ্রিক যে ইসলাম, তা বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলাম। জামায়াত-হেফাজত-জেএমবির অনুসারীরা বঙ্গীয় ইসলামকে স্বীকার করে না, মাজারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে হিন্দুদের জন্য টয়লেট নির্মাণের কথা বলে। মাজারভক্তরা বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তারা কথায় কথায় কাউকে কাফের বলে না, মজিদ যেমন বলে। ওয়ালীউল্লার বিভ্রান্তিটা এখানেই। তিনি মজিদকে দেখিয়েছেন আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি তিতুমীরের অনুসারী তথা অধুনা জামায়াত-হেফাজত ও জঙ্গিদের অনুসারী হিসেবে। অথচ মজিদকে তিনি যেখানে বসালেন, অর্থাৎ মাজারে, সেই জায়গাটা বঙ্গীয় ইসলামের জায়গা। এই মাজার সমন্বয়বাদের জায়গা, উদারতাবাদের জায়গা, গান-বাজনার জায়গা, হিন্দু-মুসলমানের জায়গা। মজিদ বলছে, গান-বাজনা হারাম। অথচ বাংলাদেশে একটা মাজারও নেই যেখানে গান-বাজনা হয় না, ওরস হয় না, হিন্দুরা যায় না। ‘লালসালু’তে ওয়ালীউল্লাহ সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সঙ্গে কট্টরপন্থী আরবীয় ইসলামের তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসটিতে মারাত্মকভাবে সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক এবং ঐতিহাসিক বিপর্যয় ঘটেছে।

বিপর্যয়টা কিভাবে ঘটেছে? তার আগে বোঝা দরকার বঙ্গীয় ইসলামের স্বরূপ। বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সুফিদের ভূমিকা যে মুখ্য ছিল সেই বিষয়ে এখন আর কোনো দ্বিমত নেই। সুফিরা শরীয়ত অপেক্ষা ঈশ্বরপ্রেমের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং স্থানীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতেন। তাতে শরীয়তপন্থী ওলামাদের চেয়ে সুফিরা অনেক বেশি গ্রহণীয় ছিলেন জনসাধারণের কাছে। সুফিরা আবার সালিক ও মজ্জুব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। সালিকেরা সুফি হলেও শরিয়তে পুরোপুরি বিশ্বাসী, আর মজ্জুবেরা শরিয়তে তত আস্থাশীল ছিলেন না। মজ্জুব বা বেশরা ফকিররাই ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদৃত। কারণ তারা ছিলেন ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ সম্পন্ন, যাকে বলা হয় কারামত। আদৌ তারা অলৌকিক কিছু দেখাতে পারতেন কিনা, এই কালে এসে সেই বিচারে আমরা যাব না। তবে এ কথা সত্য, গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেত। এই বেশরা ফকিররাই বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং মুসলমানদের পাশাপাশি বহু হিন্দুকেও তাঁদের মুরিদ বানান।

সুফিদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ছিল উদার। কট্টরপন্থাকে তারা প্রশ্রয় দিতেন না। তারা ছিলেন সমন্বয়বাদী। তাদের প্রচারিত ইসলামে যারা দীক্ষিত হয়েছিল ইসলাম ধর্ম-শাস্ত্রদি চর্চা না করে তারাও পূর্ব-পুরুষদের মতোই রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করত। হিন্দুরা যেমন গুরুর প্রতি ভক্তিশীল, তেমনই মুসলমানরা গুরুর পরিবর্তে পীরের প্রতি ভক্তিশীল ছিল। ফলে মুসলমানের পীর হলো হিন্দু গুরুর বিকল্প এবং ক্রমে ক্রমে সত্যপীর, মানিকপীর, ঘোড়াপীর, মাদারীপীর ও কুমিরপীর নামে পাঁচ পীরের পূজা আরম্ভ হলো। মাছ ও কচ্ছপকে খাদ্য দেয়া, গাছের ডালে সুতো বাধা ইত্যাদি গ্রামীণ হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানা ‘কুসংস্কার’ বাঙালি মুসলমানরা মেনে থাকে ইসলামের নির্দেশে নয়, পূর্ব-পুরুষের ধারাবাহিক বিশ্বাসে। এভাবে হিন্দুদের বনদুর্গা, ওলাইচণ্ডী প্রভৃতি লৌকিক দেবী মুসলমানদের বনবিবি, ওলাবিবির রূপ নিয়েছে। শ্রীচৈতন্যের শ্রীকৃষ্ণ নাম সংকীর্তনের মতো মুসলমানদের মধ্যেও প্রচলিত হলো মিলাদ অনুষ্ঠান। এই মিলাদ কিন্তু আরবীয় ইসলামে নেই, আছে শুধু বঙ্গীয় ইসলামে।

আবার মিলাদ ‘কেয়াম’ বা মিলাদ পড়াকালীন নবীকে হাজির-নাজির মেনে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করারও একটা নিয়ম প্রচলিত হয়, যা এখনো প্রচলিত। এটির প্রচলন হয় স্পষ্টতই শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তনের রীতি থেকে। শ্রীচৈতন্য ও তার ভক্তরা নাম সংকর্তীন করতে করতে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নৃত্য করতেন। মুসলমানদের মিলাদের মধ্যে এটিও প্রবিষ্ট হলো। মিলাদ পাঠের একটা পর্যায়ে তারা দাঁড়িয়ে যায়। সালিক সুফিরা মিলাদকে ‘বেদায়াত’ বা ইসলামে নতুন আবিষ্কার হিসেবে দেখতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজে মিলাদের রেওয়াজটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে সালিক সুফিরা মিলাদকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারেননি। মিলাদকে স্বীকৃতি দিলেও মিলাদের মধ্যে ‘কেয়াম’কে তারা স্বীকৃতি দিলেন না। কেয়ামের মধ্যে তারা স্পষ্টতই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির, যা শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত, প্রভাব দেখতে পেতেন।

অপরদিকে জন্মাষ্টমির মতোই উদযাপিত হতো নবীর জন্মদিন, যা এখনো উদযাপিত হয়। হিন্দুদের শ্রাদ্ধের মতোই ছিল পীরের মৃত্যু দিন উপলক্ষে ওরস। বিষ্ণুপাদপদ্মের মতো পূজ্য ছিল নবীর পায়ের ছাপ, কদম রসুল। চট্টগ্রামের ‘কদম রসুল’ মসজিদ আজও বর্তমান। গৌড়ের একটি সৌধে আছে পাথরের কদম রসুল বা নবীর পায়ের ছাপ। ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবারের বেরা ভাসান উৎসব আসলে ইসলামি মিথের সমুদ্র শাসক খোয়াজ খিজিরের উপাসনা। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসব বেরা ভাসানে মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদদ্দৌলাও যোগ দিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাব-প্রাসাদে দেওয়ালীও উদযাপিত হতো। দেওয়ালী লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্রের রাজ্যভিষেকের উৎসব। তার মানে এটি হিন্দু সংস্কৃতির উৎসব। মুসলমানরাও এটিকে গ্রহণ করল।

এছাড়া নবীকন্যা ফাতেমাও বিবি ফাতেমা নামে পূজিত হতেন বাংলাদেশে। কারবালার যুদ্ধের মহররম ও হাসান হোসেনের প্রাণদানের কাহিনি প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল বাংলাদেশের জনমানসে। তারই প্রভাবে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করলেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। বেগম রোকেয়াও লিখেছেন হাসান-হোসেনের কাহিনি। হাসান-হোসেন ও অন্যান্য ইমামরা নবী ও তার খলিফাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বাংলার মুসলিম জনমানসে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে। তখন গ্রামীণ সমাজে যাত্রা এবং বারোয়ারী পূজার মতো আমোদ-প্রমোদ হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে সমভাবে উপভোগ করত। মুসলমানরা হিন্দুদের মতো সমভাবে চাঁদাও দিত এসব ব্যাপারে, যদিও হিন্দুরাই ছিল এসব উৎসবের সংগঠক। মূর্তিপূজা এবং হিন্দু পুরাণের বিষয়বস্তু নিয়ে পৌরাণিক পালা ও কবিগান মুসলমানরাও উপভোগ করত। এছাড়া ছিল মুসলমানদের গাজীরামের গান এবং হিন্দুদের কীর্তনের দল। এভাবে গ্রাম বাংলার কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ছিল। পরম শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে বাস করত দুটি সম্প্রদায়। বলা বাহুল্য, মানুষের সহজাত এসব প্রবৃত্তি শরিয়ত বিরোধী, কিন্তু রক্তগত হিন্দু চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই ধরনের হিন্দু মুসলমান সমন্বয় সম্বলিত বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল মূর্তিমান বিচ্ছিন্নতাবাদ-তিতুমীরের শরিয়তী আন্দোলন তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া। তিতুমীরের আগে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ বা কট্টরপন্থার প্রচারক ছিলেন শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি, সায়িদ আহমদ বেরলবি প্রমুখ। বঙ্গীয় মুসলমান আচরিত এসব সংস্কৃতিকে তারা কুসংস্কার হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। এরা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামের পরিবর্তে প্রচার করলেন তথাকথিত বিশুদ্ধ আরবীয় ইসলাম। এই শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের উত্তরসূরী হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশের ওয়াহাবি বা খারেজি বা কওমি তরিকার অনুসারীরা, অধুনায় যারা হেফাজতে ইসলামের অনুসারী এবং জামায়াতে ইসলামির অনুসারী।

জামায়াত ও হেফাজত একই ইসলামী তরিকার অনুসারী। অর্থাৎ তারা শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের অনুসারী। কিন্তু পরবর্তীকালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর কিছু কিছু বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতে না পেরে প্রচণ্ড জামায়াত-বিদ্বেষী হয়ে পড়ে কওমি তরিকার অনুসারীরা। মওদুদীকে তারা কাফের বলতেও ছাড়ে না। বর্তমানে হেফাজত ও জামায়াতের নীতিগত ধারা দুটি হলেও মৌলিক ধারা কিন্তু এক, অর্থাৎ তারা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামকে স্বীকার করে না। তার পরিবর্তে এদেশে আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। হেফাজতের অনুসারী সালিকীয় তরিকার সুফিবাদকে স্বীকার করলেও এবং এই ধারার চর্চা করলেও মজ্জুব তরিকাকে তারা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। মজ্জুবীয় সংস্কৃতিকে তারা বেশরা কাজ বা বেদাত হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। অপরপক্ষে জামায়াতের অনুসারিরা মনে করে, সালিক বা মজ্জুব তরিকা কোনোটাই আরবীয় ইসলামের মধ্যে নেই। জামায়াত এ দুটি তরিকাকেই অস্বীকার করে। তার মানে আদর্শগতভাবে তারা পরিপূর্ণভাবে আরবীয় ইসলামের অনুসারী, যদিও বাস্তবে আরবীয় ইসলামের ছিঁটেফোটাও তাদের মধ্যে নেই।

উপরে সমন্বয়বাদী বঙ্গীয় ইসলামের যেসব সংস্কৃতির কথা বলা হলো, সেসব আগে ছিল, এখন নেই, বিষয়টা এমন নয়। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে এখনো বঙ্গীয় ইসলামের এই সহজিয়া সমন্বয়বাদী ধারা প্রচলিত রয়েছে। যেমন মাজার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত মাজার। যেমন চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের মাজার, সিলেটের শাহ্ জালালের মাজার, রাজশাহীর শাহ্ মাখদুমের মাজার, খুলনার খান জাহান আলীর মাজার। এছাড়াও বাংলাদেশের কত জায়গায় কত নামে কত মাজার যে আছে তার প্রকৃত কোনো শুমার নেই। এসব মাজারকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিটা এখনো জারি রয়েছে। যেমন মাজার ভক্তদের মধ্যে রয়েছে মিলাদ, কেয়াম, ওরস, গান-বাজনার প্রচলন। সাংস্কৃতিকভাবে তারা উদার। মাজারে মুসলমানরা যেমন যায় তেমনি হিন্দুরাও যায়। তাতে মুসলমান ভক্তদের ধর্মানুভূতিতে কোনো আঘাত লাগে না। মাজারভক্তরা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না, ইসলামের কোনো বাড়াবাড়িকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। মাজারে গিয়ে তারা পীরের সমাধীর সামনে সেজদায় উপনীত হয়। অর্থাৎ পীরকে তারা সেজদা দেয়। কারণ পীরের মধ্যেই তারা ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজে পায়। এই কারণে মাজার-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আরবীয় কট্টরপন্থী জামায়াত-হেফাজতের যত ক্ষোভ। সিলেটে শাহ্ জালালের মাজারে জেএমবি বোমা মেরিছিল এ কারণেই। মাজারগুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল জেএমবি এই কারণেই। উল্লেখ্য, জেএমবি কিন্তু সালাফি ইজমের অনুসারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। প্রকাশ্যে না হলেও নৈতিকভাবে জামায়াত এই সন্ত্রাসকে সমর্থন দিয়ে থাকে। আগেই বলেছি, আদর্শগত কিছু কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের মৌলিক আদর্শ এক। উভয়পক্ষই এ দেশকে দারুল ইসলাম বানাতে চায়।

অপরদিকে, মাজার কেন্দ্রিক এই সংস্কৃতিকে আদর্শিকভাবে সমর্থন দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের একটি ইসলামিক দল। গ্রাম বাংলায় তাদেরকে ‘সুন্নি’ বলা হয়। এই সুন্নি কিন্তু সালাফিদের মতো সুন্নি নয়। আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা কিন্তু প্রগতিশীল। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে তারা মনে প্রাণে সমর্থন করে। তারা কখনোই জামায়াত-হেফাজত বা সালাফি ইজমকে সমর্থন করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে। ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো রকমের বাড়াবাড়ি নেই। আহলে সুন্নাতের অনুসারী মৌলানারা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য প্রদান এবং সাঈদীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এই কারণেই চট্টগ্রামে শীর্ষ দশ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জামায়াত। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে জারি রেখে তারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। জামায়াত-হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা নীরবে চালিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। রাজধানী ঢাকায় বসে আমরা যারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলছি, সাদা চোখে আমরা সেই লড়াই দেখতে পাই না, বুঝতে চাই না। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে যে সাংস্কৃতিক মোকাবিলা বা লড়াইটা দরকার সেটা আমরা দিচ্ছি না, দিচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, দিচ্ছে মাজারভক্ত হাজার হাজার বাঙালি মুসলমান।

এই হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানের চরিত্র কিন্তু মজিদের মতো নয়। মজিদ যেসব কথাবার্তা বলে, এই মাজারপন্থী মুসলমানরা সেসব কথার ধারে কাছেও যায় না। প্রিয় পাঠক, এবার আপনারাই বিচার করুন ‘লালসালু’র মজিদ কি হেফাজত-জামায়াত বা সালাফিদের অনুসারী, নাকি মাজার কেন্দ্রিক বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলামের অনুসারী? এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, মজিদ সালাফিবাদী কট্টরপন্থার অনুসারী। তার কথাবার্তায় অন্তত তা-ই প্রতিভাত হয়। অথচ ওয়ালীউল্লাহ মজিদকে বসালেন মাজারে, বঙ্গীয় ইসলাম চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। মজিদের চরিত্রের সঙ্গে মাজার কোনোভাবেই যায় না। মাজারের পরিবর্তে যদি মজিদকে একটা মসজিদে বা মক্তব্যে বসানো হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’তে যে সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তিটা ঘটিয়েছেন তার পুনর্পাঠ, পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ে দাবি।



Published/Broadcast by: বাংলা ট্রিবিউন

Date published: ২৬ জুলাই ২০১৬, ১৩:২৫

Author: স্বকৃত নোমান

Entry Type: অপিনিয়ন পিস 

Source: https://www.banglatribune.com/125213/লালসালু’র-সাংস্কৃতিক-বিপর্যয়