১৬৩৮ সালের, যেখান বাংলায় মোঘল সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদি আরাকানের রাজার কাছে নোয়াখালি উপকূলে পর্তুগীজদের হামলা বিষয়ে অভিযোগ করছিলেন। সেখানে সুবাদার লেখেন যে, পর্তুগীজরা 'মুসলিম জনসাধারণের ওপর লুণ্ঠন' পরিচালনা করছে। ১৬৬০ সালে আরেকটি মোঘল সূত্র কাজিম বিন মোহাম্মদ আমীন রচিত আলমগীরনামার বিবরণ অনুযায়ী ঘোড়াঘাটের অধিকাংশ কৃষক ছিলেন মুসলমান, এটি এখনকার উত্তর বাংলার রংপুর অঞ্চল।
ইবনে বতুতা এক মহান পরিব্রাজক |
বাঙালি মুসলিম কৃষককূলের আবির্ভাব
বাঙলায় ইসলামীকরণের ইতিহাস লিখনধারার লক্ষণীয় একটা দিক হলো আগের কিস্তিগুলোয় আলোচিত এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের যারা প্রণেতা - অভিবাসন, তরবারি, পৃষ্ঠপোষকতা, সামাজিক মুক্তি - তারা তাদের তত্ত্বকে সামান্য মাত্রায়ও মৌলিক তথ্যপ্রমাণের ওপর দাঁড় করাননি। কিংবা কখন এবং কোথায় প্রথম ইসলাম একটি জনসাধারণের ধর্মে পরিণত হলো তা প্রতিষ্ঠা করার কোনো চেষ্টাও তারা করেননি। ইসলামে গণধর্মান্তর ব্যাখ্যা করতে পারার আগে প্রথমেই যতখানি সম্ভব নিখুঁতভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে ঠিক কখন এবং কোথায় প্রথম বাঙালি মুসলমান কৃষককূলের আবির্ভাব ঘটলো, কেননা যে কোন সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐতিহাসিক পুনর্গঠনকে অতি অবশ্যই স্থাপিত হতে হয় ভূগোল এবং সময়ক্রমের প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলোর ওপর।
কোন অভিমুখ থেকে বদ্বীপটিতে প্রথম ইসলামী প্রভাব পৌঁছুলো সে প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরের মানচিত্রের দিকে সামান্য দৃষ্টিপাতে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সামুদ্রিক সংযোগের ইঙ্গিত মিলতে পারে। এটা সত্যি যে, সুলাইমান তাজির (মৃত্যু ৮৫১), ইবন খুরদাদভি (মৃত্যু আনু. ৮৫), মাসুদী (মৃ ৯৫৬) এবং ইদ্রিসি (আনুমানিক ১১৫০) এর মত আরব ভূগোলবিদরা বাংলার বিষয়ে অবগত ছিলেন। এই ভূগোলবিদদের মাঝে মাসুদী বাংলায় মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা দশম শতকে সেখানে বাস করতেন। মাসুদী কথিত এই মুসলমানরা স্পষ্টতই দূরসমুদ্রগামী সওদাগর। ভারত মহাসাগরের বৃহত্তর জগতের সাথে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সংযুক্তিরই আরও ইঙ্গিত মেলে চন্দ্র রাজবংশের আমলে (আনুমানিক ৮২৫ -১০৩৫) দক্ষিণপূর্ব বাংলায় স্থানীয় মুদ্রার প্রচলন এবং লালমাই অঞ্চলে আব্বাসীয় মুদ্রার আবিষ্কার থেকে, এটি এমন একটা সময় যখন ওই মহাসাগরের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো আরব মুসলমানরা। যাহোক, সুন্নী ইসলামের হানাফি-শাফায়ী-মালিকি-হাম্বলি এই চারটি মজহাব দুনিয়া জুড়ে যেভাবে বন্টিত আছে তা পর্যবেক্ষণ করলে এই ইঙ্গিতই মেলে যে ইসলামীকরণ এখানে সমুদ্রপথে ঘটেনি। সাধারণভাবে ইসলামী দুনিয়ায় ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতে ইসলামের যারা বাহক, তাদের অনুসৃত মযহাবটি গ্রহণ করার একটা প্রবণতা দেখা গেছে।
গৌড়ের বড় সোনা মসজিদের একটি চিত্র। মোঘল আমলের আগে বাংলার সুলতানী আমল জুড়ে পর্যটকদের বিবরণে গৌড়ের মত রাজধানী নগরগুলোতেই কেবল মুসলমানদের উপস্থিতির বিবরণ মেলে। |
১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার সমুদ্রপথে ভারতে আগমনের পরবর্তী কালপর্বে ষোড়শ শতকের শুরুতে আমরা বাংলা এবং তার মানুষজন নিয়ে প্রথম দিককার ইউরোপীয় বিবরণগুলো পেতে থাকি। কিন্তু আবারো, বদ্বীপের মুসলমানদের প্রসঙ্গে এই লেখকেরা দৃশ্যত কোনোই গ্রামীন জনগোষ্ঠী নয়, কেবলমাত্র নগরবাসী মুসলমানদের বিষয়ে অবগত ছিলেন। ১৫০৩ এবং ১৫০৮ এর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে গৌড় সফর করেছেন বলে দাবি করা লুডভিকো ডি ভার্থেমা নগরটি সম্পর্কে লিখেছেন যে "এ যাবৎ আমি যতগুলো নগর দেখেছি তাদের মাঝে এটি ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ, এর বিস্তৃতি অত্যন্ত বিশাল," তিনি আরো যুক্ত করেছেন যে দুই লক্ষ সৈন্যের সমবায়ে গঠিত সুলতানের সেনাবাহিনীর সকলেই ছিল মুসলমান। ১৫১২-১৫১৫ সালের মাঝে লিখতে গিয়ে টম পিরেস - সংশয়াতীতভাবেই তার লেখার ভিত্তি ছিল বাংলায় সফরকরা বণিক ও জাহাজের অধ্যক্ষদের প্রতিবেদন - মন্তব্য করেন যে, রাজা "একজন অত্যন্ত ধার্মিক মুসলমান" এবং "এই রাজ্যের রাজারা তিনশত বছর আগে মুসলমান হয়েছেন।'' কিন্তু পিরেস সাধারণভাবে জনগোষ্ঠীর ধর্ম নিয়ে কোন কিছু উল্লেখ করেননি।
পিরেসের সমসাময়িক দুয়ার্তে বারবোসার বাংলা অঞ্চল বিষয়ক রচনাগুলোও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ নয়, পর্যটকদের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে সেগুলো রচিত। সেখানে গৌড়ের 'সম্মানিত মুর'দের অঢেল বিবরণ আছে, তার বর্ণনা অনুযায়ী যারা 'সাদা কটিবন্ধযুক্ত কুচিওয়ালা আলখাল্লা, রেশমী মস্তকাবরণ আর রুপা এবং সোনার খাপওয়ালা ছুরির বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে' হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তার লেখায় এদের উত্তম আহার্য, যথেচ্ছ ব্যয়, এবং 'আরও বহু রকমের অমিতব্যয়' প্রভৃতির উল্লেখ পরিস্কারভাবেই গ্রামীণ সমাজ নয়, নগরবাসী ধনাঢ্য বণিকদের দিকেই ইঙ্গিত করে। বস্তুত বারবোসা গৌড় নগরীকে শ্বেতকায় অধ্যুষিত একটি নগর হিসেবে বলেছেন যেখানে 'আছেন আরব, পারসি, আবেক্সিসয় এবং ভারতীয়সহ নানান দেশী আগন্তুক।' তথাপি তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন যে 'এই অংশের পৌত্তলিকরা তাদের শাসকদের আনুকূল্য পেতে নিয়মিতভাবেই মুরদের ধর্মগ্রহণ করেন"-এটাই ইসলামীকরণের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার তত্ত্বের সমর্থনে সমকালীন একমাত্র নিদর্শন হিসেবে দৃশ্যমান। কিন্তু যেহেতু তিনি রাজধানী শহরটির প্রেক্ষিত ছাড়া কখনোই মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেননি, ফলে বারবোসা দৃশ্যত এখানে কৃষকদের ইসলামীকরণ বিষয়ে বলছেন না, বরং বলছেন সেইসব হিন্দু কারিগর সম্প্রদায়ের কথা অন্যান্য উৎসগুলো যাদেরকে সালতানাতের নগরবাসী সর্বহারা শ্রেণির অর্ন্তভুক্ত করেছে।
সম্প্রতি চীনে স্থাপিত মরোক্কোর ভূপর্যটক ইবনে বতুতার (মৃত্যু ১৩৬৮) ভাস্কর্য। কেবলমাত্র ইবনে বতুতার সাক্ষ্যেই বাংলা অঞ্চলে নগরবাসী নয় এমন একটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সন্ধান মেলে। |
ফেডরিসির সফরের পর খুব বেশি দিন অতিবাহিত হবার আগেই ১৫৯৯ সালের এপ্রিল মাসে ফ্রান্সিস ফার্নান্ডেজ নামের একজন জেসুইট ধর্মপ্রচারক সুসমাচার প্রচারের উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলার মেঘনা নদীর উজান বেয়ে ভ্রমণ করেন, তিনি স্থানীয় মানুষের রীতিনীতি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং তাদের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীতে পরিণত করার সম্ভাবনা যাচাই করছিলেন। দক্ষিণপূর্ব ঢাকা জেলার নারায়নগঞ্জের নিকটবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে ফার্নান্দেজ লিখেছেন যে "আমি যাচাই করা শুরু করলাম খ্রিস্ট ধর্ম বিস্তারের আদৌ কোন সুযোগ আছে কি না, কিন্তু আমি দেখলাম মানুষজন প্রায় সবাই মুসলমান।'' এটাই বদ্বীপের যথার্থ হৃৎকেন্দ্রে মুসলিম কৃষককূলের উপস্থিতির আদিতম সংশয়াতীত উল্লেখ।
সতেরো শতকের বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলার গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের দৃশ্যমানতা বিষয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, এবং খেয়াল করেছেন যে, ইসলামের প্রসারটি খুব সাম্প্রতিককালের, মোঘল বিজয় থেকেই কেবল এর সূচনা। মোঘল শক্তি ইতিমধ্যে বদ্বীপে দৃঢ়ভাবেই স্থাপিত হয়ে যাবার পর, ১৬২৯ সালে অগাস্টিনিয় ধর্মপ্রচারক সেবাস্টিয়ান মানরিক লিখছেন "শুরুর দিকে বাংলার সবগুলো রাজ্যই পৌত্তলিক পূজাপদ্ধতির অনুসারী ছিলো, যেমনটা তাদের বেশিরভাগ এলাকায় এবং এখনও তাদের অধিকাংশ মানুষ অনুসরণ করে থাকে। যাহোক, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এই অঞ্চলটি মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হবার পর এরা পৌত্তলিক বিশ্বাস এবং নরকগামী কঠিন পথটি ত্যাগ করেছেন প্রশস্ততর এবং সহজতর সড়কটি গ্রহণ করতে, যেটি আল কোরানের পথ।" ১৬৬৬ সালে ফরাসি পর্যটক জঁ দ্য তেভেনো একই কথা বলেছেন এবং সতেরো শতকের ইউরোপীয়দের স্বভাবসুলভ একই রকম মুসলিম বিরোধী মনোভাবও প্রদর্শন করেছেন:
দেশটি [অর্থাৎ বাংলা] পাঠান রাজাদের অধীনে, (আমি বোঝাতে চাইছি) মুহাম্মদীয় ও মোঘলরা এর মালিক হবার আগে অনেক ভালো শৃঙ্খলায় ছিল, কেননা তখন তাদের ধর্মের অভিন্নতা ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে যে, বিশৃঙ্খলা এখানে মুহাম্মদীয় ধর্মের সাথে এসেছে এবং ধর্মের বৈচিত্র এখানে আচার-আচরণের কলুষতা এনেছে।
মানরিকের মতই তেভেনো নিজেও বাংলার প্রাকমোঘল যুগকে বুঝেছেন ইসলামপূর্ব সময় যুগ হিসেবেও, এবং বিশ্বাস করতেন যে কেবল মাত্র মোগল বিজয়ের পরই ইসলাম বাংলায় প্রাধান্যশীল হয়েছে, যে বিজয়টি ঘটেছে তার রচনার মোটামুটি এক শতাব্দী আগে। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে ইউরোপীয়রা পুরাতন, ইতিমধ্যেই হিন্দুকরণকৃত পশ্চিমভাগে নয়, কেবল দ্বীপের পূর্বভাগটিতেই ঘনসঙ্গবদ্ধ আকারে মুসলিম কৃষকদের দেখতে পেয়েছেন। কেননা ১৬৯৯ সালে, ফার্নান্দেজ ঢাকার গ্রামীন জনপদে মুসলিমদের সাক্ষাৎ পাবার ঠিক একশত বছর পর আরেকজন জেসুইট পাদ্রী মার্টিন এসজে, যিনি আমরা যতদূর জানি কেবল মাত্র পশ্চিমবাংলার হুগলি অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন, লেখেন যে, 'প্রায় পুরো দেশটিই পৌত্তলিকতার অনুসারী।''
আদিনা মসজিদের ব্যালকনি, পাণ্ডয়া ১৩৭৫ |