'১৮৭২ সালের আদমশুমারীতে উদঘাটিত সব চাইতে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্যটি হলো পুরনো রাজধানীগুলোর চারদিকে জড়ো হয়ে নয়, বরং বদ্বীপের পাললিক সমতলে- নিম্নবাঙলায় সুবিপুল সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে।' জেমস ওয়াইজ (১৮৯৪)
ভারতে ইসলামীকরণ বিষয়ক চারটি প্রথাগত তত্ত্ব
ভারতবর্ষে ইসলামের বিস্তার ব্যাখ্যায় সচেষ্ট এমন তত্ত্বগুলোকে চারটি মৌলিক যুক্তিকাঠামোতে সীমিত করা যেতে পারে। প্রতিটিই অসম্পূর্ণ। এর প্রথমটিকে আমি অভিবাসী তত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করবো, এটি আদৌ ধর্মান্তরের কোন তত্ত্ব নয়, কেননা এটা ইসলামীকরণকে বিশ্বাসের ছড়িয়ে পড়া হিসেবে নয়, বরং মানুষের ছড়িয়ে পড়া দিয়ে ব্যাখ্যা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ভারতের মুসলমানদের অধিকাংশই অন্য মুসলমানদের বংশধর, যারা হয় ইরানের মালভূমি থেকে স্থলপথে অথবা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে জলপথে ভারতে অভিবাসী হয়েছেন। ইরানী মালভূমি অথবা আরব সাগরের সাথে ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে এই জাতীয় কিছু প্রক্রিয়া ইসলামীকরণে নিসন্দেহে ভূমিকা রেখেছে, তবুও এই যুক্তিকে বাংলায় গণ ইসলামীকরণের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করা যায় না, এর কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হবে।
ভারতে ইসলামীকরণের প্রাচীনতম তত্ত্বটিকে আমি তরবারির ধর্মতত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করবো, এটি ভারত এবং অন্যত্র ইসলামের বিস্তারে পেছনে সামরিক শক্তির ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করে। অন্ততপক্ষে ক্রুসেডের কাল থেকে চালু থাকা এই তত্ত্বটি ঊনিশ শতকে মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যিক আধিপত্যের প্রাবল্যের সময়টিতে এবং পরবর্তীকালে বিশ শতকের শেষ ভাগে বিশ্বজোড়া ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক প্রাবল্য অর্জন করে। সপ্তম শতকের আরবে ইসলামের উত্থানকে ঊনিশ ও বিশ শতকের অনেক প্রাচ্যবিদ যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তার মাঝেই এই তত্ত্বটির সাধারণ মনোভঙ্গিটি ধরা পড়বে, যেমন ১৮৯৮ সালে স্যার উইলিয়াম মুরের কলমে তা চিত্রায়িত হয়েছে উৎকট এই বাক্যরাশিতে:
"যুদ্ধের ঘ্রাণ আরব গোত্রগুলোর বদ মেজাজকে ব্যাগ্র আনুগত্যে পরিণত করলো।... যোদ্ধার পর যোদ্ধা, সারির পর সারি, গোত্রশুদ্ধ সকলে তাদের নারী আর শিশুদের নিয়ে অন্তহীন ধারাবাহিকতায় লড়াই করতে এগিয়ে এলো। অধিকৃত নগর, গণনার অতীত লুটের মাল আর যুদ্ধের ময়দানেই 'প্রতিটি মরদের জন্য একটি বা দুটি কম বয়েসী মেয়ে' নীতিতে বাটোয়ারা করা কুমারীদের অত্যাশ্চার্য গল্পে... নতুন নতুন গোত্র গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো এবং যাত্রা শুরু করলো। তারা এগিয়ে যেতে থাকলো, এবং এগিয়ে যেতেই থাকলো, যেমনিভাবে চাক থেকে বের হওয়া পতঙ্গের দল, অথবা ভূমিকে অন্ধকারে ঢেকে দেওয়া পঙ্গপাল এগিয়ে যায়, সেইভাবে গোত্রের পর গোত্র হুড়মুড়িয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকলো, আর বড় বড় দলে পুবে আর পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়লো।"
১৯০১ সালের আদমশুমারীর ওপর ভিত্তি করে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত মানচিত্র। সবুজ অংশে মুসলমাদের প্রাধান্য। তরবারির জোরে কিংবা জাতপাতের বিরোধিতায় ইসলাম গ্রহণের তত্ত্বকে ভূগোল সমর্থন করছে না
শেষপর্যন্ত বজ্রনির্ঘোষ তোলা অশ্বক্ষুরধ্বনি বিদায় নিলে এবং ধুলো থিতিয়ে আসলে আরব বিজয়গুলোর ব্যাখ্যায় ম্যুরের এই প্রচেষ্টা থেকে সামান্যই সারবস্তু মেলে। বরঞ্চ 'যুদ্ধের ঘ্রাণের' প্রতি আরবদের অনুরাগ, 'লুটতরাজের' প্রতি তাদের ভালোবাসা, আর 'একটি বা দুটি কম বয়সী নারীর' প্রতিশ্রুতির ওপরই তিনি কেবল গুরুত্বারোপ করেন। ইসলামকে যুদ্ধ ও যৌনতার সাথে সংশ্লিষ্ট করার পুরনো ইউরোপীয় ভাবনার পাশপাশি ম্যুরের চিত্রিত এই উন্মত্ত হয়ে ওঠা যুদ্ধংদেহী, বিদ্রোহী ইসলামে ঔপনিবেশিক এই ভীতিটিও প্রতিফলিত যে, ইউরোপের নিজস্ব মুসলিম প্রজারাও ঠিক অমনই পঙ্গপালের মত বিদ্রোহে সমুত্থিত হয়ে ইউরোপীয়দের আবার ইউরোপেই খেদিয়ে দিতে পারে। সর্বোপরি, স্যার উইলিয়াম ম্যুর স্বয়ং নিজে একদিকে যেমন ছিলেন উপনিবেশিক ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ্য বৃটিশ কর্মকর্তা,একইসাথে তিনি ছিলেন সেখানে খ্রিস্টিয় মিশনারী আন্দোলনের একজন আগ্রাসী কর্মীও।
ইসলামের উত্থানের কারণ ছিল এর অন্তর্গত যুদ্ধংদেহী স্বভাব এমনটা ভেবে নিতে পারলে একই শর্তাবলী দিয়ে ভারতে এর বিস্তার ব্যাখ্যা করতে উপনিবেশিক কর্মকর্তাদের সামান্যই বেগ পেতে হতো। তথাপি যেমন পিটার হার্ডি লক্ষ্য করেছেন, ভারতীয় মুসলিমরা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে যারা যুক্তি দেন, তারা সাধারণভাবে হয় বল প্রয়োগ কিংবা ধর্মান্তর-কে সংজ্ঞায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের ব্যাখ্যা থেকে ধরে নিতে হয় যে, শ্রেফ ঘাড়ে তরবাড়ি ঠেকানোর হয়েছে বলে একটি সমাজ তার ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করতে পারে এবং তা-ই করবে।
স্যার উইলিয়াম মুর
যাহোক, তত্ত্বগতভাবে অথবা অনুশীলনগত দিক দিয়ে ঠিক কি ভাবে এই পদ্ধতিটা কাজ করেছিল, কখনোই তা সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। উপরন্তু এই তত্ত্বের প্রবক্তাগণ ১২০০-১৭৬০ সালের মধ্যবর্তী কালে উত্তর ভারতে তুর্কো-ইরানী শাসনের বিস্তারকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়, এই বিভ্রান্তি সম্ভবত 'ইসলাম' এর ভারত বিজয়ের বর্ণনা সম্বলিত প্রথম যুগের ইরানী বিবরণগুলোকে খুব বেশি আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ করার ফল। ইয়োহানান ফ্রিডম্যান যেমনটা লক্ষ করেছেন, এই বিবরণগুলোতে বারংবার এমন সব অনির্দিষ্ট বচন মিলবে, যেমন "তারা ইসলামের কাছে সমর্পণ করলো" (ইতা আত ই ইসলাম নুমুদান্দ), অথবা 'তারা ইসলামের অধীনস্ততায় আগমন করলো" (দার ইতা আত ই ইসলাম আমাদান্দ), যেখানে 'ইসলাম' বলতে ধর্ম, মুসলিম রাষ্ট্র অথবা 'ইসলামের সেনাবাহিনী' যে কোনটিই বোঝানো হতে পারে।
কিন্তু এই অনুচ্ছেদগুলোর যথাযথ প্রেক্ষিত সহকারে পাঠ সাধারণত শেষ দুটো ব্যাখ্যার কোন একটিকে সমর্থন করে, বিশেষত এজন্য যে, এই একই উৎসগুলো কখনো কখনো ইন্দো-তুর্কী সেনাবাহিনীকে 'লস্কর ই ইসলাম বা ইসলামের সেনা হিসেবে উল্লেখ করেছে, লস্কর ই তুরকান বা 'তুর্কী বাহিনী' হিসেবে উল্লেখ করেনি। অন্যভাবে বলা যায়, ওই মানুষেরা নতি স্বীকার করেছেন ইসলামী বিশ্বাসের কাছে না, ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্র, এবং আরও সুস্পষ্টভাবে, এটার সামরিক বাহুর কাছে- এমনটাই এখানে বলা হয়েছে ।
এমনকি এই তত্ত্বটি দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় ভূগোলেও খাপ খায় না। ইসলামীকরণ কখনো যদি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সংঘটিত হতো, তবে যে এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নিবিড়ভাবে এবং দীর্ঘতম কাল ধরে মুসলিম রাজবংশগুলো শাসন করেছে- অর্থাৎ যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণভাবে 'তরবারির' সম্মুখীন হয়েছে--সে অঞ্চলগুলোতেই আজকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মুসলমানরা থাকতো। কিন্তু ঘটেছে ঠিক তার বিপরীতটাই, কেননা পশ্চিম পাঞ্জাব বা পূর্ববাংলার মত যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি নাটকীয় ইসলামীকরণ ঘটেছে, সেগুলোর অব্স্থান ইন্দো-মুসলিম শাসনের একেবারে প্রান্তসীমায়, 'তরবারি' যেখানে ছিল দুর্বলতম, এবং স্থুল বল প্রয়োগ যেখানে ন্যূনতম মাত্রার প্রভাবই কায়েম করতে সক্ষম হতো। প্রথম যথাযথ আদমশুমারিটির প্রতিবেদনে এরকম অঞ্চলে মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ থেকে ৯০ ভাগ মুসলমান বলে জানা যায়, বিপরীতে উচ্চগাঙ্গেয় সমভূমিতে- দিল্লী দুর্গ আর তাজমহলের খাস এলাকায়, মুসলিম শাসকেরা যেখানে শাসন করেছেন নিবিড়তমভাবে এবং দীর্ঘতম কালপর্ব জুড়ে--মুসলিম জনগোষ্ঠী মিললো মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ। অন্য ভাবে বললে, মোটামুটি পুরো উপমহাদেশ জুড়ে মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতার গভীরভাবে অনুপ্রবেশের মাত্রা ও ইসলামীকরণের মাত্রার মাঝে একটা বিপ্রতীপ সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি বাংলার ভেতরেও এই সূত্রটি কার্যকর। ১৯০১ সালের আদমশুমারীতে যেমন দেখানো হয়েছে:
"মুসলিম শাসকদের সদরদফতর হিসেবে সুখ্যাত কোন একটা এলাকাও এই (পূর্বাঞ্চলীয়) জেলাগুলোর কোনটিতে ছিল না। ঢাকা ছিল প্রায় একশো বছর জুড়ে নবাবের আবাসস্থল, কিন্তু এর চারদিকের যে কোন জেলার চেয়ে ঢাকাতে কম অনুপাতে মুসলমানের বাস, একমাত্র ব্যতিক্রম ফরিদপুর। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে রয়েছে পুরনো রাজধানী, যেগুলো সাড়ে চারশো বছর ধরে ছিল মুসলমান শাসনের কেন্দ্র, তথাপি সন্নিহিত দিনাজপুর, রাজশাহী এবং নদীয়ার চেয়ে এখানকার জনগোষ্ঠীর অপেক্ষাকৃত স্বল্প অংশ মুসলমান।
১৮৭১ সালে অনুষ্ঠিত বৃটিশ ভারতের প্রথম আদম শুমারীতে জানা যায় যায় বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় বেশি। আদমশুমারীর প্রথম পাতার ছবি
বস্তুত, এমনকি এমন প্রস্তাবনাও আছে যে, মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতার সান্নিধ্য ইসলামীকরণের লক্ষ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার বদলে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃতপ্রস্তাবে তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এস এল শর্মা এবং আর এন শ্রীবাস্তবের মতে, রাজস্থানের নামমাত্র ধর্মান্তরিত মেও সম্প্রদায়ের ওপর মোঘলদের নিগ্রহ মেওদের ইসলামী পরিচয়কে শক্তিশালী না করে বরং তা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করার কাজটিই করেছে।
ভারতে ইসলামীকরণের ব্যাখ্যা করতে তৃতীয় আর একটি তত্ত্ব সাধারণভাবে প্রস্তাব করা হয়, যেটিকে আমি বলি পৃষ্ঠপোষকতার ধর্ম তত্ত্ব। এই মত অনুযায়ী প্রাকআধুনিক পর্বে ভারতীয়রা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে কিছু জাগতিক আনুকূল্য পাবার জন্য- যেমন খাজনা থেকে অব্যাহতি, আমলাতন্ত্রে পদোন্নতি এবং এমনি আরও কিছু। পশ্চিমে প্রশিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক সমাজবিজ্ঞানীদের মাঝে এই তত্ত্বটি সর্বদাই আনুকূল্য পেয়েছে যারা সকল ধর্মকে বিবেচনা করেন কোন না কোন জাগতিক কর্তাসত্ত্বার ওপর নির্ভরশীল চালক হিসেবে, আরও সুনিদিষ্টভাবে সামাজিক উন্নতি বা মর্যাদার অনুমিত একটি আকাঙ্ক্ষা হিসেবে। এই তত্ত্বের সমর্থনে ভারতীয় ইতিহাসের অজস্র ঘটনা দৃশ্যমান। চতুর্দশ শতকের শুরুতে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন যে ভারতীয়রা খলজি সুলতানদের কাছে নিজেদেরকে নব্যধর্মান্তরিত হিসেবে উপস্থাপন করতেন, বিনিময়ে সুলতানের কাছ থেকে তারা পেতেন পদবী অনুযায়ী মর্যাদার খেলাত।
ঊনিশ শতকের আদমশুমারীর প্রতিবেদন অনুযায়ী উত্তর ভারতের বহু ভূস্বামী পরিবার অনাদায়ী রাজস্বজনিত কারাবাস এড়াতে বা পূর্বপুরুষের জমি পরিবারের হাতে ধরে রাখতে নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমনকি এই তত্ত্বটিকে আরেকটু প্রসারিত করে মুসলিম শাসকদের কাছে চাকরি পাওয়া তেমন গোষ্ঠীগুলোকেও অন্তর্ভূক্ত করা যায়, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তরিত না হয়ে থাকলেও ইসলামী সংস্কৃতিকে অনেকাংশে আত্মীকৃত করেছিলো। গাঙ্গেয় সমভূমির কায়স্থ ও ক্ষত্রিয়*, মহারাষ্ট্রের পারাসনিস* (যারা ফারসিতে লেখাপত্রের কাজ করতেন) এবং সিন্ধুর আমিল* সম্প্রদায় এরা সকলেই সরকারের কেরানী ও প্রশাসনিক ভৃত্যের চাহিদা মেটাবার কালে ইসলামী সংস্কৃতিরই চর্চা করেছেন, এই প্রক্রিয়াটিকে আজিজ আহমেদ একদা তুলনা করেছিলেন ঊনিশ ও বিশশতকের 'পশ্চিমাকরণের' সাথে। বন্দি সৈন্য ও দাসদের দিক থেকে সাংস্কৃতিক অভিযোজন হয়তো এই প্রক্রিয়ার আরেকটি মাত্রা গঠন করেছিল। অবাক হবার কিছু নেই, আদিবাসভূমির সাথে কোন স্থায়ী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংযোগের অভাবে এই মানুষেরা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
এই তত্ত্বটি ভারতের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্রগুলোতে ঘটা অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যার ইসলামীকরণকে ব্যাখ্যা করতে যদি সাহায্য করেও, এটা রাজনৈতিকভাবে প্রান্তস্থ অঞ্চলগুলোতে ঘটা বিপুল ধর্মান্তরকে ব্যাখ্যা করতে পারে না--যেমনটা ঘটেছে পাঞ্জাব বা বাংলায়। পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে সরে যেতে থাকলে তো তরবারির প্রভাবের মতই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতারও বৃদ্ধি পাবার বদলে হ্রাস পাবার কথা। আমাদের যা দরকার তা হলো এমন একটা তত্ত্ব যা মুসলিম ক্ষমতার হৃৎকেন্দ্রে কেবল নয়, প্রান্তস্থ অঞ্চলে, এবং নগরবাসী অভিজাতদের মাঝে কেবল নয়, লাখো লাখো ভূমিসংলগ্ন কৃষিজীবীর মাঝে গণইসলামীকরণের প্রপঞ্চটাকে ব্যাখা করতে সক্ষম.
দি রাইজ অফ ইসলাম, বেঙ্গল ফ্রটিয়ার
সেই লক্ষ পূরণে সাধারণত চতুর্থ একটি তত্ত্ব হাজির করা হয়, আমি যেটার নামকরণ করেছি সামাজিক মুক্তির ধর্ম প্রকল্প। বৃটিশ জাতিতাত্ত্বিক আর ইতিহাসবিদদের দ্বারা নির্মিত, বহু পাকিস্তানী আর বাংলাদেশী নাগরিকের হাতে পল্লবিত, এবং দক্ষিণ এশিয়ার অগণিত সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ, বিশেষত মুসলমানদের গ্রহণ করা এই তত্ত্বটি বহু বছর ধরেই উপমহাদেশে ইসলামীকরণের সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া ব্যাখ্যা। এই তত্ত্বটি একটি হিন্দু বর্ণভেদ প্রথাকে স্বীকার্য বলে ধরে নেয় যেটি কাল ভেদে অপরিবর্তিত এবং তার নিজের নিন্মবর্গের প্রতি কঠোর রকমের বৈষম্যপূর্ণ। বলা হয় যে, নিপীড়ক ও যথেচ্ছাচারী উচ্চবর্ণের হিন্দুর, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের নিষ্পেষণে এই নিন্মবর্গটি পিষ্ট হয়েছে। তারপর, ইসলাম যখন ভারতীয় উপমহাদেশে 'আগত' হলো, (এই তত্ত্বের অধিকাংশ ভাষ্য অনুযায়ী) সুফী শায়খদের ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে বহন করে নিয়ে এলো তার সামাজিক সমতার মুক্তিবার্তা, ব্রাহ্মণ্য নির্যাতনের জোয়াল থেকে মুক্তি সন্ধানী এবং যা থেকে এতকাল ধরে তাদেরকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে সেই সামাজিক সমতার বিষয়ে সচেতন ওই নিপীড়িত বর্গগুলো দলে দলে ইসলামে 'ধর্মান্তরিত' হলো।
দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামের অন্তর্নিহিত সমতা আর হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত মন্দতা বলে যা উপলদ্ধি করা হচ্ছে, তাকে পাশাপাশি তুলনা করার মধ্য দিয়ে সামাজিক মুক্তির ধর্ম তত্ত্বটি ধর্মান্তরের প্রেষণা হিসেবে যেটিকে সনাক্ত করছে তা মুসলিম প্রেক্ষাপট থেকে দারুণরকমের প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু সমস্যাটি হলো এই তত্ত্বের সমর্থনে কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। উপরন্তু এটা গভীরভাবে অযৌক্তিক। প্রথমত, আজকের দিনের মূল্যবোধ অতীতের মানুষের ওপর আরোপ করার মধ্য দিয়ে এই তত্ত্ব ইতিহাসকে পেছনের দিকে পাঠ করে। ভারতের নিন্মবর্ণগুলো সম্পর্কে এমন ভাবা হচ্ছে যে, মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার আগেই নিপীড়ক একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী জুলুম কর্তৃক তাদেরকে বঞ্চিত করে রাখা সকল মানবের মৌলিক সমতা বিষয়ে তারা সহজাত কিছু ধারণার অধিকারী ছিল, যেন-বা তারা জা জ্যাক রুশো বা টমাস জেফারসনের রচনার সাথে পরিচিত ছিল।যাই হোক, বাস্তবে ভারতীয় ধর্মগুলোর সাপেক্ষে ইসলাম বিষয়ক ভাবনায় প্রাকআধুনিক মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা হিন্দুদের অসমতার বিপরীতে নিজেদের ধর্মের সামাজিক সমতার আদর্শের ওপর নয়, বরং হিন্দু বহু-ঈশ্বরবাদের বিপরীতে ইসলামী এক-ঈশ্বরবাদের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। অর্থাৎ, এই দুই সভ্যতাকে তুলনায় ব্যবহৃত তাদের মানদণ্ডটি সামাজিক নয়, ধর্মতাত্ত্বিক। বস্তুত, ইসলাম (ধর্মীয় সমতার বিপরীতে) সামাজিক সমতাকে লালন করে, এই চিন্তাটাই সম্ভবত সাম্প্রতিক একটি ধারণা, রেনেসার সময়পর্বে, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ঊনিশ শতকের মুসলিম সংস্কারকদের মাঝে ফরাসী বিপ্লবের উত্তরাধিকার থেকে যার জন্ম।
দ্বিতীয়ত, এমনকি যদি ভারতীয়তরা মানবজাতির মৌলিক সমতায় বিশ্বাস করে থাকতোও, এবং এমনকি ইসলাম তাদের কাছে সামাজিক সমতার একটি মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েও থাকে- যদিও উভয় প্রস্তাবই ভ্রান্ত বলেই দৃশ্যমান হয়- ভারতীয় সম্প্রদায়গুলো ইসলামীকরণের পর সামাজিক স্তরবিন্যাসে নিজেদের মর্যাদার উত্তরণে ব্যর্থ হয়েছিল এমন উদাহরণ অজস্র। বরং বিপরীতক্রমে, অধিকাংশ ধর্মান্তরিতই হিন্দু সমাজে জন্মসূত্রে আরোপিত সেই পূর্বতন পদবীটিই মুসলিম সমাজে শ্রেফ বহন করে নিয়ে গেছেন। এটা বাংলার জন্য বিশেষভাবে সত্য। জেসম ওয়াইজ ১৮৮৩ সালে যেমন বর্ণনা করেছেন: ভারতের অন্যান্য অংশে হীন কাজকর্ম অস্পৃশ্য হিন্দুদের দ্বারা সম্পাদিত হয়; কিন্তু বাংলায় যে কোন নোংরা বা অপ্রীতিকর পেশা মুসলমানদের ওপর ন্যস্ত। হিন্দুর কাছে যা ভূঁইমালী, মুসলমান গ্রামের কাছে বেলদার [উচ্ছিষ্টভোগী এবং শবদেহ অপসারণকারী] তাই, এবং এটা অসম্ভব নয় যে তার পূর্বপুরুষও ওই নীচজাতের অংশ ছিল।
দাখিল দরজা, গৌড়
শেষত, তরবারি এবং পৃষ্ঠপোষকতার তত্ত্বদ্বয়ের মতই সামাজিক মুক্তির ধর্ম তত্ত্বটিও ভূগোলের বাস্তবতা দিয়েও ভুল প্রমাণিত হয়। ১৮৭২ সালে যখন প্রথম নির্ভরযোগ্য আদমশুমারীটি পরিচালিত হয়, মুসলমান জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ ঘনীভবন পাওয়া যায় পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর পূর্ব সীমান্তপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে। এই অঞ্চলগুলোর লক্ষণীয় বিষয় হলো সেগুলো শুধু মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত নয়, তাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী তখনও- ইসলামের সাথে তাদের সংস্পর্শের সময়টিতে- হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে পুরোপুরি আত্মীকৃত হয়নি। বাংলায় মুসলিম ধর্মান্তরিতরা প্রধানত এসেছেন রাজবংশী, পোদ, চণ্ডাল, কোচ এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে যারা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সাথে অতি সামান্য পরিমানে পরিচিত হয়েছিল। পাঞ্জাবেও বিভিন্ন জাঠ গোত্রের বেলাতেও একই বিষয়টা সত্যি ছিল, এরা পরিশেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহদাংশ গঠন করেছে।
কিন্তু এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। বৌধায়ন-ধর্মসূত্র নামের পরবর্তীকালের একটি বৈদিক ভাষ্যে (খৃপূ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক) সেটির মর্জি অনুযায়ী নির্ধারিত 'পরিচ্ছন্ন' বর্ণগুলোর মূল্যবোধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপমহাদেশকে তিনটি পৃথক সমকেন্দ্রিক বৃত্তে বিভক্ত করেছে, প্রতিটি স্বতন্ত্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় দ্বারা অধ্যুষিত। এর প্রথমটি হলো আর্যাবর্ত, বা আর্যদের আবাসভূমি যা আজকের উত্তর-মধ্য ভারতের উর্ধগঙ্গা-যমুনা অঞ্চলের সাথে মেলে; সেখানে বাস করতো ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের 'শুদ্ধতম' উত্তরাধিকারীগণ, নিজেদের যারা উচ্চজাত এবং শুদ্ধাচারী হিসেবে করতো। দ্বিতীয় বৃত্তটি একটি বহিস্থঃ অঞ্চলকে ধারণ করতো (অবন্তী, অঙ্গ-মগধ, সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণপথ, উপভ্রত, এবং সিন্ধু-সৌবীর) যা এখনকার মালব, পূর্ব ও মধ্য বিহার, গুজরাট, দক্ষিণাত্য এবং সিন্ধুর সাথে মেলে। এই অঞ্চলগুলি ইন্দো-আর্য জনবসতির আওতার ভেতর অবস্থিত, কিন্তু 'বর্ণসঙ্কর' জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত যারা প্রথম অঞ্চলটির মানুষদের মত একই মাত্রার শুদ্ধাচারের অনুসারী ছিল না। আর তৃতীয় সমকেন্দ্রীক বৃত্তে ছিল সেইসব 'অশুচি' গোত্র অধ্যুষিত সেই বহিস্থ অঞ্চল, তখন পর্যন্ত সেগুলো সভ্যতার আওতা বহির্ভূত হিসেবে বিবেচিত বলে যেখানে ভ্রমণকারীদের প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেয়া হতো। এই তৃতীয় বৃত্তে বসবাস করা জনগোষ্ঠীগুলো হলো পাঞ্জাবের আরাট্টা, দক্ষিণ পাঞ্জাব আর সিন্ধুর সৌবীর, উত্তর বঙ্গের পু-্র এবং মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গের ভঙ্গ জনগোষ্ঠী।
এখন, সামাজিক মুক্তির তত্ত্বটিতে একটি সুপ্রোথিত ও নিপীড়নমূলক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের পৌরহিত্যে উচ্চমাত্রার একটি স্তরবিন্যস্ত সামাজিক গঠনের পূর্বঅস্তিত্ব ধরে নেয়া হয়। এই তত্ত্বটি যদি সঠিক হতো, তাহলে যৌক্তিকভাবেই ইসলামে ধর্মান্তরের বৃহত্তম ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল সেই সব অঞ্চলে যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক বিন্যাস ছিল গভীরতমভাবে প্রোথিতÑ অর্থাৎ, আর্যবর্তের কেন্দ্রভূমিতে। উলটোদিকে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে কম অনুসারী পাবার কথা ছিল সেই সব এলাকাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতার সাথে যাদের পরিচয় ঘটেছে সবচেয়ে কম, অর্থাৎ প্রান্তিক অঞ্চল জুড়ে বা সেই সভ্যতার চৌহদ্দীর বাইরে, বৌধায়ন-ধর্মসূত্রে বর্ণিত তিনটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের বহিস্তঃতমটিতে। কিন্তু ঠিক সেই বহিস্তঃ বৃত্তটিতেই দক্ষিণ এশীয়ার অধিকাংশ মুসলমানের বসতিÑ সেই এলাকাটি যা পূর্ব আর পশ্চিমে দুই অংশ সম্বলিত পাকিস্তানের আদি রাষ্ট্রকাঠামোয় (১৯৪৭) অন্তর্ভূক্ত হওয়া অঞ্চলগুলোর সাথে মোটাদাগে মিলে যায়। দেশভাগ-পূর্বকালীন দক্ষিণ এশিয় মুসলমানদের অধুনাকালের বন্টনের বিন্যাস এভাবে এই তত্ত্বটির পূর্বাভাসের ঠিক বিপরীত একটি ফলাফলই নির্দেশ করেÑ যার মানে হলো যত কম ব্রাহ্মন্য সভ্যতার সাথে পূর্বপরিচয় ঘটেছে, তত বেশি পরবর্তীকালে ইসলামীকরণের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের 'প্রান্তসীমায়' বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী যদি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক স্তরবিন্যস্ত সমাজে পুরোপুরি আত্মীকৃত নাই হয়ে থাকে, একটি নিপীড়নমূলক হিন্দু সামাজিক বিন্যাস থেকে পলায়নের প্রশ্নটিও যুক্তিসঙ্গতভাবে উঠতে পারে না, প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও যেমনভাবে তা হয়ওনি।
(চলবে)
[প্রবন্ধটি রিচার্ড এম ইটনের রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। বাংলা অনুবাদ স্বত্ত্ব ইউপিএল কর্তৃক সংরক্ষিত]
Published/Broadcast by: The Business Standard (Bangla)
Date published: 01 August, 2020, 12:35 am
Last modified: 01 August, 2020, 11:43 am
Author: ফিরোজ আহমেদ/রিচার্ড এম ইটন
Entry Type: অনুবাদ
Source: https://tbsnews.net/bangla/ইজেল/গণ-ইসলামগ্রহণ-তত্ত্ব-এবং-প্রবক্তাগণ?fbclid=IwAR21l4kuUWpHPuzL_uvIbyg3gQwJUxv8ahVQ0akBb7MQvd5nOdATN4AzBjo
Date published: 01 August, 2020, 12:35 am
Last modified: 01 August, 2020, 11:43 am
Author: ফিরোজ আহমেদ/রিচার্ড এম ইটন
Entry Type: অনুবাদ
Source: https://tbsnews.net/bangla/ইজেল/গণ-ইসলামগ্রহণ-তত্ত্ব-এবং-প্রবক্তাগণ?fbclid=IwAR21l4kuUWpHPuzL_uvIbyg3gQwJUxv8ahVQ0akBb7MQvd5nOdATN4AzBjo