ব্রিটিশরা যখন মোটামুটি গোটা ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠা করল, দিল্লিভিত্তিক মুঘলদের দাপ্তরিক কাগজপাতি অনুসারে তারা গোটা অঞ্চলকেই মোটাদাগে ফারসি শব্দ ‘হিন্দুস্তান’ দিয়ে ডাকতে আরম্ভ করল। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ রচিত নানান মানচিত্রে গোটা ভারতবর্ষের নাম হিন্দুস্তান হিসেবে লিখিত হতে দেখা যায়। কিন্তু এটা নিয়ে বিলেতাগত ব্রিটিশ অফিসাররা মাঠে ময়দানে কাজকর্ম করতে গিয়ে পড়ল এক সমস্যায়। তারা দেখল উত্তর থেকে মধ্য ভারতের একটা সীমাবদ্ধ অঞ্চলের বাইরে কেউ হিন্দুস্তান চেনে না১। এই বাস্তবতার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয় আর্থার কোক সম্পাদিত এংলো-ইন্ডিয়ান অভিধানটি। যেখানে ‘হিন্দুস্তান’ বলতে চিহ্নিত করা হয় বিশেষভাবে বাংলা ও বিহার ব্যতিরেকে নর্মদা নদীর উত্তর পাশের বাকি ভূখণ্ডকে২। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতেও এই একই এলাকার বিবরণ দেয়া আছে। অর্থাৎ আধুনিক সময়ে যে অংশটুকু পাকিস্তানের বালুচ সীমান্ত থেকে উত্তর-ভারতের মহারাষ্ট্রের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত [মানচিত্র ০১]। এই হচ্ছে মূলত ঐতিহাসিক হিন্দুস্তান। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের হিন্দুস্তানকে যারা জন্মশত্রু মনে করে সেই ‘পাকিস্তান’ও আসলে ১৯৩০’এ কবি ইকবাল’এর পাকিস্তান-প্রস্তাবের আগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক হিন্দুস্তানেরই অংশ ছিল। এমনকি কবি ইকবাল নিজেও ‘সারে জহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্থাঁ হমারা’ শিরোনামে গানটানও লিখেছেন। আদতে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভিন্ন কোনো সাংস্কৃতিক/ ঐতিহাসিক ভূখণ্ড নয়।
উপরন্তু, বাঙালিকে বুঝতে হবে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান এগুলো কেবল
অভিন্ন ভূখণ্ডই না, বরং একটি অভিন্ন মানসিক অবস্থাও বটে! ভূখণ্ড দু’টো
বিহারের সীমান্তে এসে শেষ হলেও মানসিকতাটি বার বার চেষ্টা করেছে ওই
সীমান্তটা ডিঙিয়ে বাঙালির মানসিক পরিসরে ঢুকতে। ক্ষেত্রবিশেষে সফলও হয়েছে।
অনেকাংশে হয়ওনি! তো সেই মানসিকতাটা আসলে কী? খুব মোটাদাগে বললে– এটি হচ্ছে
বাস্তুচ্যুত দখলদারদের মানসিকতা।
আর্য’রা হচ্ছে আদি-পারসিকদের থেকে তাড়া খাওয়া মধ্য-এশিয় দখলদারের দল৩। এখানে দুটো জিনিস লক্ষ্যণীয়। বাস্তুচ্যুত এবং দখলদার। কারণ, বাধ্য হয়ে উত্তর-ভারতে অভিবাসনের পরে সেখানকার বাসিন্দা না হয়ে মালিক বনে গ্যাছে তারা৪, ৫। এই মালিক বনবার প্রক্রিয়ায় তাদেরকে গোটা অঞ্চলে নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়োজনেই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বও প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে৫। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান নামক অঞ্চলে মানুষের ভেতরে তাই ধর্ম ব্যাপারটি আত্মীক নয়, বরং মূলত রাজনৈতিক অস্তিত্বরক্ষার হাতিয়ার। সহস্রাব্দের অভ্যাসবশত তাই– যেকোনো বিরোধীপক্ষকে তারা মোকাবেলা করেছে ধর্মীয় ভিন্নতা/শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলে টার্কিক দখলদারদেরকে তাদের জাতিগত পরিচয়ে নয়, বরং লড়া হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। এমনকি সেই দখলাভিযানের ফলে ধর্মান্তরিত আর্যরাও ধর্ম ঠিকই বদলেছে, কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী মানসিকতা বদলায়নি। তাই এই অঞ্চলের মানুষ ধর্ম-নির্বিশেষেই নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের থেকে আলাদা করতে সক্ষম নয়। উত্তর-ভারতীয় হিন্দুস্তানি বা পাকিস্তানিরা তাই যে অভিন্ন মানসিকতাটি ধারণ করে তার নাম ধর্মীয় রাজনীতি! তাদের ঢাল এবং তলোয়ার দুটোই এই একই।
অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত এবং বাংলার পরিস্থিতি মৌলিকভাবেই ভিন্ন। কারণ- এই ভূখণ্ডগুলো মূলত ভূমিপুত্র অধ্যুষিত অঞ্চল। আধুনিক নৃতাত্ত্বিক ও জেনেটিক গবেষণা ভারতবর্ষের মানুষের রক্ত-সাংকর্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করছে যে– দক্ষিণ ভারতে সরাসরি আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে অতি সামান্য [৪]; আর বাংলায় আর্য উপনিবেশের পরিবর্তে যেটা ঘটেছে তাহচ্ছে জাতি-নির্বিশেষে সুযোগভিত্তিক অভিবাসন৬, ৭, ৮। দক্ষিণ ভারতীয়দের অনার্যতা বা বাঙালির অতি-সাঙ্কর্য্য যেটা প্রমাণ করে তাহচ্ছে– একাংশের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণবাদিতা, আর অপর অংশের উদারতা৮। বাস্তুচ্যুত-দখলদার অধ্যুষিত উত্তর-ভারত ঐতিহাসিকভাবেই এই দুই মানসিকতার কোনোটিকেই ধারণ করতে সমর্থ নয়। অবশ্য দক্ষিণ ভারতীয় সংরক্ষণবাদিতাকে তারা যদিও কিছুটা হলেও বোঝে– বাঙালির উদারতা তারা কিচ্ছুটিও বোঝে না৯। বোঝে না বলেই এক অজানা আতংকে ভোগে বাঙালিকে নিয়ে। এই ‘অদ্ভুত’ মানসিকতা তারা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু দখলদার হিসেবে তারা যেটা করতে পারে তাহচ্ছে নিজ মানসিকতাকে নিজেদের ভৌগলিক সীমানার বাইরে বিস্তৃত করা।
এই মানসিক দখলদারিত্বেরই একটি অংশ হচ্ছে ধর্মীয় শুদ্ধতার বড়ি! উত্তর-ভারতীয় মুসলমান যেমন মনে করে বাঙালি মুসলমান সহীহ মুসলমান নয়; উত্তর-ভারতীয় হিন্দুও মনে করে বাঙালি হিন্দু ঠিক বিশুদ্ধ হিন্দু নয়। এর প্রমাণ ৭১ পূর্ববর্তী পাকিস্তানভুক্ত বাঙলা, এবং বর্তমানের ভারতভুক্ত বাঙলা। তাই বাঙালিকে নিজেদের মতো ‘ধার্মিক’ (আদতে ধর্মাশ্রয়ী দখলদার) করে তোলার ট্রেনিং দিতে এরা সতত এক পায়ে খাড়া! এই আধুনিক সময়েও তাই এরা নিজেদের অজুত দালাল আর নিযুত পুঁজিকে লড়িয়ে দিচ্ছে বাঙালিকে নিজেদের আর্যত্বের ছাঁচে ফেলতে। উত্তর-ভারতের মতো করে ভাবতে, উত্তর-ভারতের মতো করে মারতে এবং মরতে!
তাই, উত্তর-ভারতীয় উষ্কানিতে ধর্মের ধ্বজা তুলে যতবার বাঙালির ভুখণ্ডে রক্তপাত হয়, তা সে কলকাতায় হোক বা নোয়াখালিতে হোক, ততবার একটু একটু করে জিতে যায় উত্তর-ভারত১০, ১১। ততবার একটু একটু করে জিতে যায় পাকিস্তান। ততবার একটু একটু করে জিতে যায় হিন্দুস্তান। বাঙালি কি তার শিকড়ের ডাকে সাড়া দেবে, নাকি দখলদারের পদলেহন করবে সে সিদ্ধান্ত আধুনিক বাঙালিরই। বাঙালিকে কিন্তু জিততে হবে। বাঙালি হিসেবেই জিততে হবে! বাঙালি যেভাবে জেতে, তেমন ভাবেই জিততে হবে!
জয় বাংলা!
Published/Broadcast by: bdnews24.com
Date published: ৪ মার্চ, ২০২০
Last modified: ৪ মার্চ, ২০২০
Author: আশফাক আনুপ
Entry Type: Opinion Piece
Source: https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/59794